শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল
লেখিকা: নূরজাহান বিনতে আব্দুল মাজীদ (রুকু)
প্রকাশনায়: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয়: ঈমান আক্বিদা-মানহাজ, শির্ক-বিদ’আত
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৫৪
কভার: পেপার ব্যাক
স্রষ্টা হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলী প্রয়ােজন, সেগুলাের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে তুলনা বা সাদৃশ্যপূর্ণ করলে, সে মুশরিক হয়ে যাবে। ক্ষতি করা, উপকার করা, দান করা ও দান না করার একক অধিকারী হওয়া ইলাহীর বৈশিষ্ট্য, তথা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। আর এ সব গুণাবলীর একক অধিকারী হওয়ার কারণে প্রার্থনা করা, ভয় করা, কোন কিছুর আশা করা এবং ভরসা করা কেবলমাত্র তার সাথেই সম্পৃক্ত হতে পারে। সুতরাং, যদি কোন ব্যক্তি এ সব গুণকে কোন মাখলুক বা সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত করে, তাহলে সে যেন সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে শরীক সাব্যস্ত করল। আর দুর্বল, নিঃস্ব ও সসীম কোন কিছুকে ক্ষমতাবান, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তার। সাথে তুলনা করা খুবই নিকৃষ্ট মানের তুলনা। যে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব প্রকাশ করে এবং তার প্রশংসা করার জন্য, তাকে সম্মান করার জন্য, তার কাছে অবনত হওয়া ও আশা করার জন্য মানুষকে আহ্বান করে, তাহলে ঐ ভয় করা, আশা করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে মানুষের অন্তরকে তার সাথে সম্পৃক্ত করার কারণে নিশ্চয়ই সে আল্লাহর একত্ব ও প্রভুত্বের ক্ষেত্রে সংঘর্ষে লিপ্ত হল। আসলে শিক হল আল্লাহর প্রতি অতি নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম একটা ধারণা বা বিশ্বাস।
শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল
‘শির্ক-বিদআত-কুসংস্কার, পীর-ফকীর ও মাযার এ সবই পাপের আধার, বাঁচতে হবে সবার’
নূরজাহান বিনতে আব্দুল মাজীদ (রুকু)
সম্পাদনায়: ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ হাছান
তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা
লেখিকার কথা
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও গুণগান একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও প্রতিপালক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ সুবহানাহ্ ওয়া তা’আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যিনি ব্যতীত প্রকৃত সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি তাঁর সত্তায় যেমন এক ও অভিন্ন, তেমনি গুণাবলীতেও অনন্য ও অতুলনীয়। আমরা কেবল তাঁরই প্রশংসা করি, তাঁর নিকটেই সাহায্য চাই এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আমাদের অন্তরের কুমন্ত্রণা, অনিষ্টতা ও মন্দ আমল হতে তাঁরই আশ্রয়ে বাঁচার দৃঢ় আশা পোষণ করি। অজস্র সলাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সহধর্মিণী ও সাহাবীগণের ওপর।
মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এ পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সমস্যা-সংকট বাড়ছে হু হু করে। হতাশা বাড়ছে মানুষের প্রতিনিয়ত। হতাশ মানুষেরা আর কোন পথ না পেয়ে হয় ভাগ্যের ওপর সঁপে দিচ্ছেন নিজেকে; নয়ত পীর, ফকীর, দরবেশ ও জ্যোতিষীর পরামর্শ গ্রহণ করছেন। সহজে হাতে পাওয়া তথা অতি আকাঙ্ক্ষা বুকে পোষা মানুষও এ-সব মতলবী মানুষদের নিকট ধর্ণা দিয়ে মহা-মূল্যবান ঈমান, আক্বীদা, অর্থ-সম্পদ এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে আবারও হতাশায় তলিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান না রাখা সমাজের শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অসহায় ও গরীব তথা সর্বস্তরের মানুষই কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের নাগপাশে বন্দী। এ শ্রেণীর মানুষ তাদের জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ, অভাব ও দারিদ্রের জন্য কুরআন ও সহীহ হাদীসের দলীল- প্রমাণহীন ঈমান ও আকীদা বিধ্বংসী তথাকথিত অলৌকিক বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাস রেখে চলেছেন। মূলত আমাদের গ্রামীণ সাধারণ মানুষ ও শহুরে আধুনিক সমাজে শির্ক-বিদআতযুক্ত কুসংস্কার, আচার, প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর রয়েছে ব্যাপক প্রভাব ।
দিনক্ষণ দেখে যাত্রা করা, রাশিফল গণনা, পীরবাবা, ও খানকা শরীফের মুরীদ- ভক্ত, হস্তরেখা, জ্যোতিষশাস্ত্র, রত্ন-পাথর ধারণ, তাবিজ-কবজ, যাদু-তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি আরও কত রকমের শিরক ও কুফরী যে আমাদের চারদিক ছেঁয়ে রেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। খোদ ইসলাম ধর্মের তথাকথিত পণ্ডিতরাই অধর্মের অঙ্কধারণা প্রচার করে থাকেন। এমন নজির আমাদের সমাজে বহু মেলে। ধর্মশাস্ত্রে যথেষ্ট ভাল জ্ঞান রাখেন এ ধরনের ব্যক্তিদের জীবন-যাপন বা চিন্তাধারা অধর্মে চালিত- এ রকম তো অহরহই দেখা যায়। এমনও প্রায়ই শোনা যায়, শ্রেণীতে শিক্ষা দেয়ার সময় তাবিজ-কবজ, মৃত মানুষের অসীলা গ্রহণ, মৃত ব্যক্তির নিকট থেকে ফয়েজ-বরকত লাভ, পীর-মুরীদী, কোন ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণের মতো ইত্যাকার বিষয়াদির স্বপক্ষে নানা ভিত্তিহীন যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করে শিক্ষার্থীদেরকে লেলিয়ে দেন এ সবের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। এমনই যদি প্রকৃত ব্যাপার হয়, তবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কুরআন ও সহীহ হাদীস তথা ওহীর সত্য শিখবে কেমন করে। এ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম যেভাবে সাজানো তাতে বিশুদ্ধ আক্বীদামনস্ক হবার আয়োজন খুবই কম। আর ব্যবহারিক সহীহ আকীদার চর্চা নেই বললেই চলে।
সুতরাং কুরআন ও হাদীসের চর্চা করে শিক্ষার্থীরা কুরআন-সহীহ হাদীসমুখী হবে, সে ভরসা করার জো নেই। কুরআন-হাদীসমুখী হওয়াটা বর্তমানে একটা বিশেষ জরুরি বিষয় বলে ধরে নেয়া যায়। কারণ আমাদের মুসলিম সমাজ জীবনে যে শির্ক, বিদ’আত, গোঁড়ামী, ধর্মীয় দলীল-প্রমাণ-যুক্তিহীন অন্ধধারণা ও কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা দূর করে ওহীর সত্যের দিকে যাত্রার একমাত্র পথই হল কুরআন ও সহীহ হাদীসের জ্ঞান। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অন্ধ-বিশ্বাস ও অন্ধ-অনুসরণের ঐতিহ্য উপড়ে ফেলতে জোরালো সহায়তা করতে পারে কুরআন ও সহীহ হাদীসমুখী চিন্তা বা চেতনা। তাই কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক শিক্ষার হার বাড়ানো এবং সে সাথে আরো বেশি প্রয়োজন এগুলো চর্চার প্রসার ঘটানো। এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটিতে আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত নানা চেহারার, নানা চরিত্রের ধর্মীয় শিরক ও কুসংস্কারজনিত শির্কগুলো নিয়ে বাস্তবসম্মত আলোচনা স্থান পেয়েছে। গল্পের অবয়ব বানিয়েও বলা হয়েছে। অসংখ্য অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখিত হয়েছে। কিছুটা হলেও এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটি আমাদের গ্রাম ও শহুরে জীবনে ব্যাপকভাবে প্রচলিত শির্কগুলো বাতিল করে মানব সমাজকে ওহীর সত্যের দিকে ধাবিত করতে সহায়ক হতে পারে। এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটি ইসলামের প্রকৃত সত্য গ্রহণে চোখ খুলে দেবার কাজ করবে বলে আশারাখি ।
পরিশেষে, একটি কথা না বললেই নয়; তা হচ্ছে, কখনো ভাবিনি যে, এ বিষয়গুলোর সমষ্টি একদিন বই আকারে রূপ নেবে। কারণ, বই লিখতে গেলে যা প্রয়োজন, যেমন- পর্যাপ্ত জ্ঞান, তথ্য ও উপাত্ত, মেধা ও প্রজ্ঞা; এগুলোর কোনটাই আমার নেই। তবে, আমাদের সমাজে প্রচলিত শির্ক ও কুসংস্কারগুলোর একটা দীর্ঘ তালিকা তৈরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম । এক সময় অবশ্য একটা ছোট তালিকা তৈরিও হয়ে গেল। তারপর মনে ইচ্ছা জাগল যে, এ ছোট্ট তালিকার সাথে বিষয়সংশ্লিষ্ট আরও কিছু কথা যোগ করে প্রবন্ধ আকারে রূপ দেয়া যেতে পারে। অবশেষে, তা-ই হল। কিন্তু এখানেই ঘুরে গেল আমার মূল কাজের মোড়। তাওহীদ পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী ওয়ালিউল্লাহ ভাই আমার লেখা প্রবন্ধটি দেখে সেটির সাথে আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় যুক্ত করে বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। আমি তাঁর এ কথায় উৎসাহিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন শুরু করলাম এ উদ্দেশ্যে যে, প্রবন্ধটিতে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তাছাড়া, একটা কথা তো সবারই জানা যে, প্রবন্ধ বা নিবন্ধ আর বইয়ের উপস্থাপনা ভঙ্গী সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ্র ইচ্ছায় সেই ছোট প্রবন্ধটি এখন বই রূপে আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হল, ফালিল্লাহিল হামদ।
এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটি প্রণয়নে লেখার বিষয় ও ধরন নির্বাচন, বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহে প্রয়োজনীয় গ্রন্থের (Reference Book) সন্ধান প্রদান, তথ্যাবলী ও ভাষা সম্পাদনাসহ বইয়ের অন্তর্ভূক্ত বিষয়সমূহের যথাযথ সন্নিবেশ সাধনে ইঞ্জি. মুহাম্মাদ হাছান ভাই আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন।
এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটি রচনাকালে অনেক গ্রন্থ দ্বারা অনুপ্রেরিত হয়েছি এবং সেগুলো থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছি; যে সকল বিদ্বানের লেখনীর সাহায্য গ্রহণ করেছি, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁদের সকলকে অফুরন্ত রহমত দান করুন। মহিমান্বিত আল্লাহ তা’আলা এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল বইটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে জাযায়ে খায়র দান করুন। এটাকে লেখিকা, সম্পাদক, প্রকাশক ও পাঠক-পাঠিকাদের পিতামাতা ও তাঁদের পরিবারের জন্য নাযাতের অসীলা রূপে গ্রহণ করুন। আমীন ।
বিনীত,
নূরজাহান বিনতু আবদুল মজীদ (রুকু)
সম্পাদকীয়
মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় রোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোগটি হল তাওহীদের ধারণা সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং এ বিষয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞানের দুঃখজনক অপর্যাপ্ততা। মুসলিম জীবনে আল্লাহ্ একত্রে ব্যাপ্তি এবং ত্ব কতখানি তা মুসলিমরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ কথা বলার আপেক্ষা রাখে না যে, তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ই হচ্ছে ইসলামের মূল ও কেন্দ্রীয় শক্তি। মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া, আমৃত্যু সঠিকভাবে মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে তাওহীদ সম্পর্ক ঠিক রা ওপর। মুসলিমদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম তাওহীদের ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।
তাওহীদের বিপরীত হচ্ছে শির্ক। শির্ক হচ্ছে কঠিন ও জঘন্যতম পাপের কাজ, যার সাথে নগণ্যতম সম্পর্কও কোন প্রকৃত তাওহীদপন্থী মুসলিম মেনে নিতে পারে না। অধিকাংশ মুসলিম তাওহীদের মূল তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। তাওহীদের প্রকৃত সংজ্ঞা নিরূপণে তারা মূল সত্য থেকে দূরে সরে পড়েছে। তাওহীদপন্থী মুসলিমরাই যেহেতু এ জগত থেকে শির্ক নির্মূল করার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের বাতিলের মধ্যে নিজেদের নিপাতিত হওয়া কিরূপে সম্ভব?
মূলত, শির্কের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং তাওহীদের প্রতি ভালবাসা ও সহানুভূতি একটি জ্ঞানগত গৌরবের বিষয়। তাওহীদ বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন মানুষের মন থেকে শির্ক সম্বন্ধীয় সমূদয় অন্ধ ধারণাকে বিলীন করে দিতে সক্ষম। এর ফলে শির্কের জণ্ডালে জড়িয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকবে না। আসলে, শির্ক বিষয়টি কী? এর রূপরেখা ও প্রকরণ কী? আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চরিত্র, নৈতিকতা ও সামাজিক-পারিবারিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক তথা আমাদের জীবনের রন্ধে রন্ধে এটা কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জন প্রতিটি মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যক।
তাওহীদের সঠিক জ্ঞানের অভাবে বাংলাদেশী মুসলিমদের সংস্কৃতি আজও প্রকৃত ইসলামীরূপ নেয়নি, বরং তা ইসলামী ভাবধারা হতে বিচ্যুত হয়ে একটা অস্পৃশ্য বিজাতীয় সংস্কৃতির ঘোলাটে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। আজ অহর্নিশি মুসলিমদের কণ্ঠে শোনা যায়, হরে কৃষ্ণ সংকীর্তন এবং বড়দিনের নর্তন-কুর্দন। এ দেশীয় মুসলিমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে বিদআতী-শিকী-কুফরী আচরণ করছে, ভিন্ন ধর্মের জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির চর্চার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে; আর এর ফলে সর্বক্ষণ তারা কুসংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক যাচ্ছে। হিন্দুদের তীর্থ-মন্দিরের বিকল্প হিসেবে মুসলিমরা মাযার গড়ে তুলছে, চর্চা করছে মাযার পূজা বা প্রতিমা সংস্কৃতির। বর্তমান মুসলিম জীবনের এ বিচিত্র দিকগুলো তুলে ধরার জন্য এ বইটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে রয়েছে হাজারো রকমে কুসংস্কার। স্বল্পশিক্ষিত ও ইসলামী জ্ঞানহীন লোকেরা ধর্মীয় ও প্রাত্যহিক জীবনের নানাবি আচার, প্রথা ও ইবাদতপন্থা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট বিষয় আবিষ্কা মনোযোগী হয়ে পড়ে। সে সবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও নতুন মাত্রা সংযোজনের জন্য আর নানাবিধ অদ্ভুত ধারণা ও পন্থার প্রচলনের উদ্ভব ঘটায়। কুসংস্কারগুলোকে করে তো আরও গতিশীল ও জনপ্রিয়। তাদের এ উদ্ভাবনী শক্তি সত্যিই বিস্মিত হওয়ার মতো একটি বিষয়। তাদের এ সকল শিরকী কর্মকাণ্ড তথা কুসংস্কারের মূল এত গভীরে প্রোথিত যে এত সহজে এর মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানই জনগোষ্ঠীই মূলত এ ধারার অনুসারী। এদেরকে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান দেয়ার জন্য ও সম থেকে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কার দূরীকরণের নিমিত্তে চাই একটা সমন্বিত প্রয়াস। অর সে প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এ বইটি।
এক প্রগাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত জাহেলিয়াতে কুহেলিকায় পরিপূর্ণ বিশ্বমানবতাকে মুক্ত করে তাওহীদী আলোর দিকে পরিচালিত করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ (স)। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত শির্ক-কুফরীযুক্ত যাবতীয় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধ্যান- ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে প্রতিষ্ঠা করেন এক শির্কমুক্ত পরিচ্ছন্ন তাওহীদী ইসলাম সমাজ। বর্তমানে আমরা মুসলিম সমাজের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই। মুসলিম সমাজ শির্ক-বিদআত ও নানা কুসংস্কারের দুশ্ছেদ্য মায়াজালে বন্দী, বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনসাধারণ যেন এর শিকার হয়েছে অনেক বেশি।
গ্রামবাংলা ও শহরকেন্দ্ৰীক শত সহস্ৰ কুসংস্কারের সংযোজন করে লেখিকা এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগী হননি। কেবলমাত্র হাতে গোনা কয়েকটি কুসংস্কার ও শির্কী কর্মকাণ্ডের কথা বলে একটা গ্রহণযোগ্য চিত্র পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এখানে। সমাজ সংস্কার একটা মহতী বিষয় হলেও তা খুবই দূরূহ ব্যাপার। সে জন্য চাই প্রতিভা আর পাণ্ডিত্য এবং যে বিষয়টি বেশি প্রয়োজন তা হল, জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে এমন রচনাশৈলী তথা প্রভাব বিস্তারকারী সাহিত্য সৃষ্টির উন্নত কলা-কৌশল । মুসলিমদের লক্ষ্যহীন অসহায় জীবনধারাই লেখিকাকে এ জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর রচনায় যেমন রয়েছে উদ্দীপনা তেমনি রয়েছে চলার পথের সঠিক পাথেয় ও প্রেরণা। এ ধরনের হৃদয়স্পর্শী আরো রচনা এ সমাজকে উপহার দেয়ার মতো যোগ্যতা লেখিকাকে আল্লাহ তা’আলা প্রদান করুন- এটাই আমরা আন্ত রিকভাবে দু’আ করছি।
বিনীত,
ইঞ্জিনিয়ার হাছান
উপক্রমণিকা
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে এ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র তাঁরই ইবাদাতের নিমিত্তে সৃষ্টি করেছেন।
‘আমি জ্বিন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ‘ইবাদাত করবে।” [সূরা যারিয়াত (৫১): ৫৬]
যুগে যুগে তিনি অসংখ্য নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন, কিতাবসমূহ অবতরণ করেছেন যাতে মানবজাতি তাঁর স্পষ্ট পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়, তাঁর “ইবাদাত করে এবং তাঁর একত্বের স্বীকৃতি দিতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণরূপে একমাত্র তাঁরই বিধান যেন বাস্ত বায়িত হয়ে যায়। সকল আনুগত্য শুধুমাত্র তাঁর জন্যই নির্ধারিত হয়ে যায় এবং সমস্ত প্রার্থনা নিবেদন যেন তাঁরই উদ্দেশ্যে হয়। আর এ সবের বিপরীতমুখী কোন কর্মকাণ্ড যেন সম্পন্ন না করা হয়। কারণ এগুলোর বিপরীত বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডই শিরক তথা তাঁর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করা।
ইসলাম আমাদের মুসলিমদের ধর্ম। আর এ ইসলাম ধর্মের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী সংস্কৃতি। এ ইসলামী সংস্কৃতি আজ বাংলাদেশে প্রচণ্ডভাবে বিকৃত হচ্ছে। মুসলিমদের মধ্যে প্রবেশ করেছে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সংস্কৃতি, আবার এ মুসলিমরাই করছে হরে কৃষ্ণ সংকীর্তন অর্থাৎ তারা একদিকে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও অন্যদিকে হিন্দু সংস্কৃতি- এভাবে বিজাতীয় সংস্কৃতির পূজারী হয়ে উঠেছে। পরানুকরণ করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তারা হারিয়ে ফেলেছে এবং নিজেরাও হারিয়ে গেছে পর-সংস্কৃতিতে বা বিজাতীয় সংস্কৃতিতে। যে জাতি তার নিজের স্বরূপ হারিয়ে ফেলে সে জাতি অবশ্যই বিজাতীয় বেশে আবির্ভূত হয়। পরানুকরণের কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শির্ক-কুফরীযুক্ত কুসংস্কার জাতীয় নানা পাপাচার ও অনাচার মহা দাপটে বিরাজ করছে। অজ্ঞতার কারণে যেমন আমরা বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ ও অনুকরণ করছি তেমনি অজ্ঞতার কারণেই আমরা নানা বিষয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এ কুসংস্কার আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমভাবেই ক্রিয়াশীল ।
কলুষতাপূর্ণ আক্বীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণার বিস্তৃতি ঘটছে অনেক পথে, নানা মাধ্যম ধরে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে নিত্য নতুন পথ ধরে এ হামলার প্রচণ্ডতা কেবল বিস্ত ত থেকে বিস্তৃততরই হচ্ছে। শয়তানের এ চোরাগুপ্তা হামলার অসংখ্য পথ আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানবতা ও সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করার জন্য এমন কোন মাধ্যম নেই যা শয়তানেরা ব্যবহার করছে না। রেডিও, টিভি, ভিসিআর, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, সিনেমা, নাটক, নানা ধরনের পত্রিকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল বিনিময়, সাহিত্য, ট্যুরিজম, ভিউকার্ড, ওয়াল পোষ্টার, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালা, গৃহসজ্জা সামগ্রী, সামাজিক অনুষ্ঠানমালা, বিলাস সামগ্রী, উৎসব, মেলা, সকল প্রকার প্রচার-যোগাযোগ ও গণমাধ্যম সর্বত্র শয়ত্বান তার ভয়ানক থাবা বিস্তার করে আছে।
ফলে অন্যান্য বিভ্রান্ত জাতিগুলোর মতো প্রকাশ্যভাবে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবেই) মুসলিমরা আজ সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য, সাফল্য, ব্যর্থতা, লাভ, লোকসান ইত্যাদির জন্য অসংখ্য স্ৰষ্টাসূলভ সত্তার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। এ মতাদর্শ অবলম্বনকারীগণ আন্দাজ অনুমানের সাহায্যে স্রষ্টাসূলভ শক্তিসমূহের উৎস ও অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। ফলে এ অনুসন্ধান চলাকালীন যে যে শক্তির ওপর তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে তাদেরকেই এরা স্রষ্টা মনে করেছে। এ কারণে মানবজীবনে যে রকম আচরণ সক্রিয় হয়েছে তা হল:
প্রথমত, মানুষের সমগ্র জীবন অবাস্তব অনুমানের পাদপীঠে পর্যবসিত হয়। মানুষ তখন বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিসম্মত পন্থা ব্যতীত নিছক আন্দাজ-অনুমানের সাহায্যে অসংখ্য ব্যক্তি ও বস্তুকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করতে শুরু করে। তারা অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক পন্থায় মানুষের ভাগ্যের ওপর ভাল কিংবা মন্দ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম বলে মনে করে। এ জন্য উক্ত মতের বিশ্বাসী ব্যক্তিগুলো ভাল প্রভাবের অবাস্তব আশায় এবং মন্দ প্রভাবের অবান্তর ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে বিপুল শক্তি অর্থহীনভাবে অপচয় করে। সামান্য কু-আলামত দেখলে মন ভেঙ্গে যায়, হতাশায় কাতর হয়। এ বিশ্বাসই তার মতাদর্শ, চিন্তাধারা এবং তার চেষ্টা-সাধনাকে স্বাভাবিক কাজ হতে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত ক’রে এক সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক পথে পরিচালিত করে ।
দ্বিতীয়ত, এ বিশ্বাসের কারণেই পূজাপাঠ, মানত, উপহার ইত্যাকার আচার অনুষ্ঠানের এক দীর্ঘ কর্মতালিকা রচিত হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, এ মুশরিকী কল্পনাপূজার কুসংস্কারে যারা নিমজ্জিত হয়, ধূর্ত ও শঠ ব্যক্তিরা তাদেরকে নিজের প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে অর্থ লুণ্ঠন করার বিরাট সুযোগ লাভ করে, ফলে কেউ রাজা বা বাদশাহ হয়ে বসে এবং চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রসহ অন্যান্য দেবতার সাথে নিজের বংশের সম্পর্ক দেখায়, কেউ ব্রাহ্মণ ও পীর, তাবীজ, ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র এবং সাধনার জাল বিস্তার করে; আর লোকদেরকে বিশ্বাস করায় এ সব জিনিস অলৌকিক, এগুলো সকল প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে, ব্যাথা-বেদনা প্রশমিত করতে পারে ।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মুসলিমরা আজ যে কষ্ট ও মুসীবতে জর্জরিত, এর প্রধান কারণ হল, তাদের মধ্যে প্রকাশ্য ও ব্যাপকভাবে শিরক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যে আজ ফিৎনা- ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে, তা আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর গযব হিসেবে নাযিল করছেন। কারণ, তারা তাওহীদ বিমুখ হয়ে পড়েছে এবং তাদের আক্বীদা ও কর্মকাণ্ডে শিরক প্রকাশ পাচ্ছে। বেশিরভাগ মুসলিম দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। শিরককে উৎখাত করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব এ কথা মুসলিম সমাজ জানলেও কোটি শির্কী কাজ তা না জানার কারণে শিরকী কাজকেই পুণ্যের কাজ মনে করে আমল করে যাচ্ছে। তাই এ সব প্রচলিত শিরকের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে না।
শির্ক: পরিচয় ও এর প্রকারভেদ
“শির্ক শব্দটি কুরআন ও হাদীসে বহুল ব্যবহৃত একটি আরবী শব্দ। আভিধানিক আর্থে শির্ক হল ‘অংশীদারীত্ব, বণ্টন’ বা ‘সহযোগী বানানো’ কিন্তু ইসলামী পরিভাষায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোন প্রকারে আল্লাহর সাথে শরীক বা অংশীদার সাব্যস্ত করাই শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা আল্লাহর প্রাপ্য কোন ‘ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালন করা বা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকাকে শির্ক বলা হয়।
শির্কের পারিভাষিক সংজ্ঞায় আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, শির্ক হল আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ রূপে গ্রহণ করা এবং আল্লাহ মত তাকে ভালবাসা ।
মূলত আল্লাহ তা‘আলা যে সকল কথা, কাজ ও বিশ্বাসকে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব রূপে নির্ধারণ করেছেন, সেগুলোর সব কিংবা কোন একটি গায়রুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করাই হল শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শির্ক করার অর্থ হল, কোন সত্তাকে-
১. আল্লাহ তাআলার সাথে একজন সঙ্গী জুড়ে দেয়া,
২. সহায়ক বা অংশীদার মনে করা,
৩. আর সমকক্ষ মনে করা,
৪. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদাত করা,
৫. বহু উপাস্যবাদে বিশ্বাস করা,
৬. কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদায় শরীক করা,
৭. তার নিকট প্রার্থনা জ্ঞাপন করা,
৮. কোন কিছু আশা করা,
৯. তাকে ভয় করা,
১০. তার ওপর ভরসা করা,
১১. তার নিকট সুপারিশ চাওয়া,
১২. তার নিকট বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ফরিয়াদ করা,
১৩. তার নিকট এমন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থনা করা যার সমাধান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নিতে পারে না,
১৪. তার নিকট মীমাংসা চাওয়া,
১৫. আল্লাহর অবাধ্যতা করে তার আনুগত্য করা,
১৬. তার কাছ থেকে শারীয়াতের বিধান গ্রহণ করা,
১৭. তার জন্য কিংবা তার নামে যবেহ করা,
১৮. তার নামে মানত করা,
১৯. তাকে এটুকু ভালবাসা যতটুকু আল্লাহকে ভালবাসা উচিত।
অন্য কথায়, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইলাহ বা মাবুদ সাব্যস্ত করা সাধারণত শির্ক হিসেবে গণ্য। মূলত শির্ক হচ্ছে সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করা। অর্থাৎ স্রষ্টা হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলী প্রয়োজন, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে তুলনা বা সাদৃশ্যপূর্ণ করলে, সে মুশরিক হয়ে যাবে। ক্ষতি করা, উপকার করা, দান করা ও দান না করার একক অধিকারী হওয়া ইলাহীর বৈশিষ্ট্য, তথা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট গুণাবলীর অন্তর্ভূক্ত। আর এ সব গুণাবলীর একক অধিকারী হওয়ার কারণে প্রার্থনা করা, ভয় করা, কোন কিছুর আশা করা এবং ভরসা করা কেবলমাত্র তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত হতে পারে। সুতরাং, যদি কোন ব্যক্তি এ সব গুণকে কোন মাখলুক বা সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত করে, তাহলে সে যেন সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে শরীক সাব্যস্ত করল । আর দুর্বল, নিঃস্ব ও সসীম কোন কিছুকে ক্ষমতাবান, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তার সাথে তুলনা করা খুবই নিকৃষ্ট মানের তুলনা ।
যে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব প্রকাশ করে এবং তার প্রশংসা করার জন্য, তাকে সম্মান করার জন্য, তার কাছে অবনত হওয়া ও আশা করার জন্য মানুষকে আহ্বান করে, তাহলে ঐ ভয় করা, আশা করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে মানুষের অন্তরকে তার সাথে সম্পৃক্ত করার কারণে নিশ্চয়ই সে আল্লাহর একত্ব ও প্রভুত্বের ক্ষেত্রে সংঘর্ষে লিপ্ত হল । আসলে শির্ক হল আল্লাহর প্রতি অতি নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম একটা ধারণা বা বিশ্বাস। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোন প্রকার মাধ্যম দাঁড় করানো, তাঁর প্রভুত্ব, রবূবিয়্যাত ও একত্বের প্রতি চরম আঘাত এবং তাঁর সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করার শামিল । আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর বান্দাদের জন্য এরূপ ধারণা করাকে কিছুতেই অনুমোদন করেন না। তাছাড়া, স্বাভাবিক জ্ঞান ও নিষ্কলুষ প্রকৃতিও একে পরিত্যাগ করে এবং সুস্থ প্রকৃতি ও উন্নত স্বভাবের নিকট এটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় বলে বিবেচিত।
শির্কের তাৎপর্য:
শির্কের অর্থ শুধু এটা নয় যে, কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বা তাঁর প্রতিপক্ষ মনে করা হবে। আরবের মুশরিকরাও কাউকে আল্লাহর সমান বা প্রতিপক্ষ মনে করত না । বরং শির্কের প্রকৃত তাৎপর্য হল, যেসব বস্তু একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, সেগুলোকে অন্য কারো জন্য করা, যেমন- অন্যকে সিজদা করা, অন্যের উদ্দেশ্যে মাথা নত করা, বিপদে অন্যকে আহ্বান করা, জীবিত পীর-খাজা-গাউস-কুতুবের কাছে সন্তান, রোগ নিরাময়, ব্যবসায়ে উন্নতি, বিপদ হতে পরিত্রাণ ও পারলৌকিক সুপারিশ ও মুক্তির প্রার্থনা করা, কাউকে আইন দাতা বিধান দাতা মনে করা অর্থাৎ হুকুম ও বিধান প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করা এবং কুরআন-সুন্নাহ আইনের বিরোধী মানব রচিত সংবিধানের আনুগত্য করা, কাউকে গাউসূল আযম বা মহান ফরিয়াদ শ্রবণকারী ধারণা করা, ইবাদাতের সময় পীরের কল্পনা করা ইত্যাদি।
শির্ক হল জঘন্যতম গুনাহ। এটা এমন এক গুনাহ যার জন্য কোন ক্ষমা অবশিষ্ট নেই আল্লাহর নিকটে, যদিও তিনি অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এ ব্যতীত অন্য সব, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করল, বস্তুত সে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করল। [সূরা নিসা (৪): 88]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আর আমি অবশ্যই উপদেশ গ্রহণের জন্য। সুতরাং উপদেশ এ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না, এছাড়া অন্য সব যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে, সে চরমভাবে গোমরাহীতে পতিত হল।” [সূরা নিসা (৪): ১১৬)]
শির্ক মিশ্রিত যেকোন ‘আমল ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন এবং আল্লাহর নিকটে তা প্রত্যাখ্যাত। ফলে একজন মানুষের ঈমান, সারা জীবনের ‘আমল বিফল হয়ে যেতে বাধ্য কেবলমাত্র শির্কী কর্মকাণ্ডের কারণে। মূলত শির্ক মানুষের ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও অভ্যাসের মধ্যকার যেখানেই হোক, এটা এমন একটা বিষক্রিয়া যে, যদি কারো জীবনে কখনও একটি মাত্র শির্কও সংঘটিত হয় এবং সে ব্যক্তি তা থেকে তাওবা করে মৃত্যুবরণ করতে না পারে, তাহলে কেবল এই একটিমাত্র শির্কই তার ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্মকে নিষ্ফল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এ ধরনের লোকদের ঈমান ও আমলের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“বল, “আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেব নিজেদের ‘আমালের ক্ষেত্রে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেসব লোক দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা- সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সৎকর্ম করছে।” [সূরা আল-কাহাফ (১৮): ১০৩-১০৪]
“আর আমি তাদের আমলের দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর তা (তাওহীদ শূন্য হওয়ার কারণে) বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দিব।’ (সূরা ফুরক্বান: (২৫) ২)
কেবলমাত্র আল্লাহর তাওহীদের স্বীকৃতি দান, এর সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। ফলে এ পৃথিবীতে আগমনকারী প্রতিটি নবী বা রাসূল সর্বপ্রথম তাওহীদের দিকেই আহ্বান এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য বারবার তাকিদ জানিয়েছিলেন। তাওহীদের মর্মবাণী প্রচারের জন্য জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেছেন তাওহীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রচারক রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এ বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ সম্পর্কে খুব কমই গুরুত্বারোপ করা হয়। এমনকি ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় এ বিষয়ে তেমন লেখালেখিও হয় না। ফলে, তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার জন্য তাওহীন পরিপন্থী বিষয় তথা শির্ক আমাদের মুসলিম সমাজের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। আর শির্ক এমনই ভয়াবহ ও জঘন্যতম পাপ যা থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের আবশ্যিক কর্তব্য। শিরকের ব্যাপারে রাসূল মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে নবী) কিন্তু তোমার কাছে আর তোমাদের পূর্ববর্তীদের কাছে ওয়াহী করা হয়েছে যে, তুমি যদি (আল্লাহ্) শারীক স্থির কর, তাহলে তোমার কর্ম অবশ্য অবশ্যই নিম্ফল হয়ে যাবে, আর তুমি অবশ্য অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ [সূরা আয্-যুমার (৩৯): ৬৫)]
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীস্থাপন করে তার জন্য আল্লাহ অবশ্যই জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন আর তার আবাস হল জাহান্নাম।’ [সূরা মায়িদাহ (৫): ৭২]
এ কারণে বান্দার ওপর সর্বপ্রথম অপরিহার্য বিষয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তাওহীদের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা এবং নিজের ঈমান, আক্বীদা ও যাবতীয় ‘আমল শির্ক মুক্ত রাখা, যাতে কোন ‘আমল বরবাদ না হয়। তাওহীদের প্রকৃত জ্ঞান না থাকলে, কোন জ্ঞানই পরিপূর্ণ নয়। তাওহীদ বিহীন কোন ‘আমলও গ্রহণীয় নয়। তাছাড়া, আল্লাহ্ দ্বীন তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূলকথাই হচ্ছে কালিমায়ে তাওহীদকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা ও এর উপর মৃত্যু পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা। আর এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার দাবী হচ্ছে এ তাওহীদকে বিনষ্টকারী শির্ক নামের মহা অপরাধটি কী এবং সমাজে এটি কেন সংঘটিত হয়, সে সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখা। তা না হলে যেকোন সময় শয়তানের খপ্পরে পড়ে যে কারো ঈমান ও জীবনের সৎকর্মের যাবতীয় সাধনা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এহেন গুরুতর পরিণতির হাত থেকে যেমন নিজেকে রক্ষা করা আবশ্যক, তেমনি এ থেকে অন্য সকল মুসলমানকেও রক্ষা করা আবশ্যক ।

শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল
Reviews
There are no reviews yet.