যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড
বই: যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড
লেখক: ‘আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলাবানী (رحمه الله)
প্রকাশনায়: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয়: হাদীস, হাদীস বিষয়ক আলোচনা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬০১
বইটি কিনতে কিল্ক করুন: যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড
আরো জানতে কিল্ক করুন: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
উম্মাতের মাঝে জাল ও যইফ হাদীছ এর কুপ্রভাব দূর করতে মুহাদ্দিসগণের প্ররিশ্রমের অন্ত নেই। আল্লাহর এই ওয়াহী সংরক্ষণ করতে তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। তারা ছহীহ ও যঈফ হাদিস গুলোকে আলাদা করে আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন যাতে আমরা যঈফ হাদিসের উপর আমল করে বিভ্রান্ত না হই। এছাড়া যেন আমরা ছহীহ হাদীছের উপর আমল করতে পারি। এরকমই একজন গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা মুহাদ্দিস শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (رحمه الله)। তিনি যঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ নিয়ে “সিলসিলাতুল যঈফাহ ওয়াল মাউযুআহ’ নামে হাদীছ সিরিজ লিখেছেন। যার বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
বইটির বৈশিষ্ট্য:
● যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড বইটির শুরুতেই হাদীছ সংকলন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে।
● যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড গ্রন্থটির তাহক্বীক বুঝতে হাদীছের পরিভাষা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
● বিভিন্ন বিষয়ের হাদীছগুলো ছড়িয়ে থাকলে সূচিপত্রে তা বিষয়ভিত্তিক আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে হাদীছটির মানও উল্লেখ করা হয়েছে।
● হাদীছটি কোন গ্রন্থে রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
● হাদীছটির বিভিন্ন রাবী সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের উক্তি উল্লেখ সাপেক্ষে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (رحمه الله)-এর তাহক্বীক উল্লেখ করা হয়েছে।
● কোন হাদীছের অংশবিশেষ ছহীহ হলে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি সিলসিলাহ সহীহাহতে থাকলে তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।
● কোন হাদীছের তাহক্বীক আলবানী (رحمه الله) পরবর্তীতে পরিবর্তন করলে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড
এবং
উম্মাতের মাঝে তার কুপ্রভাব
চতুর্থ খণ্ড
হাদীছ ১৫০১-২০০০
মূলঃ
আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (رحمه الله)
অনুবাদঃ
আবূ শিফা মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন বিন বাদীউযযামান
লীসাপ মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।
এম, এ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
সম্পাদনাঃ
শাইখ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম
লীলাপ- মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।
এম এ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
শাইখ আমানুল্লাহ বিন ইসমা’ঈল
লীসান্স মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব।
ইসলাম মানুষের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও শাশ্বত জীবন বিধান। এতে মানব কল্যাণের যাবতীয় দিক বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের মূল উৎস হ’ল আল্লাহর ‘অহি’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। আল্লাহ তা’আলা নিজেই যিক্র তথা অহি-কে হেফাযত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আমরা বিক্র নাযিল করেছি এবং আমরাই তার হেফাযত করব (হিজর ৯)। এই ঘোষণা পূর্বেকার কোন এলাহী কিতাব সম্পর্কে তিনি দেননি। ফলে সেগুলির কোন অস্তিত্ব এখন পৃথিবীতে নেই। অনেকের ধারণা ‘যিকর’ বলে আল্লাহ কেবল কুরআনের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, হাদীছের নেননি। একথা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যি’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকটে ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে” (নাহল-৪৪)। আর কুরআনের ব্যাখ্যাই হ’ল ‘হাদীছ’। যা রাসূল নিজ ইচ্ছা মোতাবেক বলতেন না, যতক্ষণ না তাঁর নিকটে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। যেমন আল্লাহ বলেন,’রাসুল তাঁর ইচ্ছামত কিছু বলেন না, যতক্ষণ না তাঁর নিকটে ‘অহি’ নাযিল হ’ত’ (নাজম ৩-৪)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘জেনে রেখ। আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্তু’ (আবুদাউদ, মিশকাত হা/১৬৩)। সে বস্তুটি নিঃসন্দেহে ‘হাদীছ’, যার অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুমিন হ’তে পারবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রভুর শপথ। তারা কখনোই মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়সমূহে তোমাকেই একমাত্র সমাধানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালা সম্পর্কে তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ বোধ করবে না এবং অবনত চিত্তে তা গ্রহণ করবে।
অনেকের ধারণা কেবল লেখনীর মাধ্যমেই হেফাযত হয়, স্মৃতির মাধ্যমে নয়। তাদের একথা ঠিক নয়। কেননা প্রাচীন পৃথিবীতে যখন কাগজ ছিল না, তখন শিলালিপি ইত্যাদি ছাড়াও প্রধান মাধ্যম ছিল মানুষের ‘স্মৃতি’। জাহেলী যুগে আরবদের স্মৃতিশক্তির প্রখরতা ছিল কিংবদন্তীর মত। যা আজকালকের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। শেষনবীকে আরবে প্রেরণের পিছনে সেটাও অন্যতম কারণ হতে পারে। এরপরেও রাসূলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনায় ‘কুরআন’ লিপিবদ্ধ ও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। হাদীছ লিখনের কাজও তাঁর নির্দেশে শুরু করা হয়। যদিও ব্যাপকহারে সবাইকে তিনি এ নির্দেশ দেননি। কেননা তাতে কুরআনের সঙ্গে হাদীছ মিলে যাবার সম্ভাবনা থেকে যেত। রাসূলের মৃত্যুর পরে উক্ত সম্ভাবনা তিরোহিত হবার পর ছাহাবীগণ হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনে মনোনিবেশ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীন হাদীছ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয় (৯৯-১০১ হিঃ) সর্বপ্রথম ব্যাপকহারে হাদীছ সংগ্রহ, সংকলন ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্ত রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেন ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে বারেজী-শী’আ, কাদারিয়া-মুরজিয়া ইত্যাদি বিদ’আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা সমূহের উদ্ভব ঘটলে তাদের মধ্যে নিজেদের দলীয় স্বার্থে হাদীছকে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দেয়। ৩৭ হিজরীর পরের যুগে তখনই প্রথম হাদীছ বর্ণনাকারীর দলীয় পরিচয় ও স্বভাব-চরিত্র যাচাইয়ের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীণ (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন, এসময় যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তি ‘আহলে সুন্নাত” দলভুক্ত, তাহ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। আর যদি দেখা যেত বিদ’আতী দলভুক্ত, তাহ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না (মুকাদ্দামা মুসলিম পৃঃ ১৫)। বলা বাহুল্য, মুসলিম সমাজে প্রচলিত শিরকী আক্বীদা ও বিদ’আতী রসম-রেওয়াজ সমূহের অধিকাংশেরই মূল উৎস হ’ল জাল ও যঈফ হাদীছ সমূহ। আল্লাহ পাক মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত স্বীয় যি’ তথা সর্বশেষ ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও হাদীছ সমূহকে হেফাযত করার জন্য যুগে যুগে অনন্য প্রতিভাসমূহ সৃষ্টি করেছেন। ছাহাবী ও তাবেঈগণের যুগ শেষে বিস্ময়কর মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ কুতুবে সিত্তাহর মুহাদ্দিছগণ ছাড়াও যুগে যুগে হাদীছের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাঁর বাছাইকৃত কিছু বিদ্বান চিরকাল হাদীছের খিদমত করে গিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর অতুলনীয় প্রতিভা মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী (رحمه الله) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছহীহ ও যঈফ হাদীছের উপর পৃথক গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছেন। যার অন্যতম হ’ল যার প্রতি খণ্ডে ৫০০ যঈফ ও মওযূ হাদীছ সংকলিত হয়েছে। এযাবৎ প্রাপ্ত এর ১৪টি খণ্ডের মধ্যে ১ম খণ্ডের বঙ্গানুবাদ করেছে স্নেহাস্পদ আকমাল হুসাইন বিন বাদী উদ্যামান।
বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য এটা ছিল অতীব যরূরী কাজ। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করে সে জাতির এক মহান খিদমত আঞ্জাম দিয়েছে। আল্লাহ তার এই ফ্লিমত কবুল করুন। আমরা আশা করব সে বাকী গুগুলির অনুবাদের কাজও করবে ও আল্লাহর রহমতে তা প্রকাশিত হবে। ইনশাআল্লাহ এ গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ যঈফ ও জাল হাদীছের অপপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে হাদীছের অনুসারী হবে।
তার এ অনুবাদ সুন্দর, সাবলীল ও সহজবোধ্য হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে পাঠকদের উপকারে আসবে। যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড গ্রন্থটি সকলের সংগ্রহে রাখার মত। আমি যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ডগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। আমীন।
রাজশাহী ৭ই মার্চ ২০০৪
প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সাবেক চেয়ারম্যান, আরবী বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ভূমিকা
আলহামদুল্লিাহ্ অস্সলাতু অস্সালামু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদিওঁ অ- ‘আলা আলিহি অ আসহাবিহী অমান তাবিয়াহুম বিইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন। অবাদ…..
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! রসূল (স) আল্লাহর মনোনীত দ্বীন (ধর্ম) ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে পৌঁছে দিয়ে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন। তিনি তাঁর সাথীগণকে দ্বীনের যাবতীয় সব কিছু শিখিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়েও গেছেন। আর তারা ছিলেন এমন এক গোষ্ঠী যাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট ছিলেন আবার তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। আমাদের সামনে যার সাক্ষ্য দিচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াতঃ
অর্থাৎ : মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম সারির অগ্রণী আর যারা তাদেরকে যাবতীয় সৎকর্মে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্ত দুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হল মহান সফলতা।
আর নাবী (স) এর দ্বীনী অরিস হিসেবে তাঁর সাথীগণসহ তাদের পরবর্তী সালাফগণও দ্বীনের যাবতীয় বিধানাবলী এবং সুন্নাতকে হেফ্য এবং হেফাযাত এবং সঠিকভাবে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেও কোন প্রকার কার্পণ্য করেননি। বরং তারা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এতই সজাগ ছিলেন যে, তারা মানুষের ধর্মীয় ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শারী’আতের বিধান হিসেবে বর্ণিত তাঁর জীবনের ছোট/বড় কোন কিছুই সংরক্ষণ করতে এবং অন্যদের নিকট পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে কোন প্রকার অবহেলাও করেননি। আর এ কারণেই তারা রসূল (স)-এর সর্বাবস্থার যেমন তাঁর গৃহে অবস্থান ও সফর, নিরাপদ ও যুদ্ধ, সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি সর্ব সময়ের এমনকি তাঁর স্ত্রীগণের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের জন্য শিক্ষণীয় যাবতীয় বিষয়কে বর্ণনা করে গেছেন। যার প্রমাণ মিলে আবূ যার এর নিম্নোক্ত বাণী থেকে। তিনি বলেন: রসূল (স) আমাদেরকে এমতাবস্থায় ছেড়ে গেছেন যে, বাতাসে কোন পাখি তার ডানাদ্বয় নাড়ালে তার সম্পর্কেও তিনি আমাদেরকে জ্ঞান দিয়ে গেছেন।
আর রসূল (স) বলেছেন : সেই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার আত্মা! আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছুর নির্দেশ দিতে ছাড়িনি যা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে আর জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। আবার আমি তোমাদেরকে এমন কোন কিছু থেকে নিষেধ করতেও ছাড়িনি যা তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে আর জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দিবে।
তিনি আরো বলেছেন : ইরবায ইবনু সারিয়্যাহ্ হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: রসূল (স) আমাদেরকে এমন এক নাসীহাত করলেন যে, এর ফলে চক্ষুগুলো দিয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল আর অন্তরগুলো ভীত হয়ে গেল। অতঃপর আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! নিশ্চয় এ নাসীহাত এমন এক নাসীহাত যার দ্বারা আপনি যেন আমাদেরকে বিদায় জানাচ্ছেন! অতএব আপনি কি আমাদেরকে কোন উপদেশ দিবেন? তিনি বললেন : “আমি তোমাদেরকে এমন এক সুস্পষ্ট পথের [যা অস্পষ্টতাকে গ্রহণ করে না। উপর রেখে যাচ্ছি যার রাত তার দিনের মতই। আমার পরে এ সুস্পষ্ট পথ থেকে একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ পথভ্রষ্ট হবে না। তোমাদের যে ব্যক্তি দীর্ঘজীবী হবে সে অচিরেই বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তোমাদের মাড়ির দাঁত দিয়ে সুন্নাতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর [অর্থাৎ সুন্নাতকে কাঠোরভাবে ধারণ করবে ] ……
খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে এ কারণে বলেছেন যে, তারা তাঁর সুন্নাত ব্যতীত অন্য কোন কিছুর উপরে আমল করতেন না- যেমনটি মোল্লা আলী কারী বলেছেন। আর রসূল (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ করাই ছিল তাদের তরীকা। তাদের ন্যায় সুন্নাতের উপর কঠোরভাবে অনুসরণকারী এ পৃথিবীতে আর কারো আবির্ভাব ঘটেনি। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বানিয়েও বলেননি। যার প্রমাণ সামনের আলোচনা থেকে মিলবে ইনশাআল্লাহ্।
পাঠকবৃন্দ! লক্ষ্য করুন বহু যুগ অতীত হয়ে গেলেও এবং ইসলামকে কলুষিত করার লক্ষ্যে ইসলাম বিদ্বেষী যিন্দীক এবং ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে ভেজালের সংমিশ্রণ ঘটানোর দ্বারা ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের বহু অপচেষ্টা সত্ত্বেও আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন কুরআনকে তো হেফাযাত করেছেন-ই, (বক্র হৃদয়ের অধিকারীদের দ্বারা তাঁর নাবীর সুন্নাতকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এবং অপব্যাখ্যার দ্বারা ভেজালযুক্ত করার অক্লান্ত অপচেষ্টা সত্ত্বেও) প্রতিটি যুগেই একদল হকপন্থী সত্যিকারের ঈমানদার ও নাবী (স) এর অনুসারীদের দ্বারা সুন্নাতকেও হেফাযাত করছেন এবং তা কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ্। অলিল্লাহিল হামদ।
আমরা যদি একটু পেছন ফিরে দেখি তাহলে দেখব যে, রসূল (স) তাঁর যুগেই সহাবীগণকে (প্রকারান্তরে তাঁর উম্মাতকে) তাঁর সুন্নাতকে হেফ্য করতে এবং যথাযথভাবে তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন : “তোমরা আমার থেকে (গ্রহণ করে) বা আমার উদ্ধৃতিতে একটি আয়াত হলেও (অন্যদের নিকট) পৌঁছে দাও। *
আবার তিনি বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন : উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয়। এ হাদীস দু’টি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তাঁর নাবী (স) এর মাধ্যমে যা কিছু আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন তাই হচ্ছে দ্বীন এবং তিনি সেটিকেই অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে বলেছেন আবার তিনি সেটিকেই যারা তাঁর নিকট হতে সরাসরি শুনেছেন তাদেরকে অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। উভয় হাদীস এটিও প্রমাণ করে যে, দ্বীনের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু সংযোগ করে প্রচার করার কোনই সুযোগ নেই। কারণ কেউ তা করলে রসুল (স) এর উপরোক্ত হাদীসের সাথে তার কর্মের সংঘর্ষ বেধে যাবে। তাঁর থেকে বা তাঁর উদ্ধৃতিতে যে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা আর বাস্তবায়িত হবে না। ফলে রসূল (স) এর নির্দেশ-বিরোধী কর্মের মধ্যে পড়তে হবে। আর এ কারণে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন যে তাঁর অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন তাও বাস্তবায়িত হবে না। আবার তাঁর অনুসরণ করলে যে আল্লাহর অনুসরণ করা হয় সেটিও উপেক্ষিত হবে এবং প্রত্যাখ্যাত হবে।
রসূল (স) শুধুমাত্র পৌঁছে দেয়ার নির্দেশই দেননি, বরং তিনি যে ব্যক্তি হাদীস শুনে হেফয করে অন্যের নিকট সেভাবেই পৌঁছালো যেভাবে সে শুনেছে তার জন্য দু’আও করেছেন। “আল্লাহ্ সেই বান্দার চেহারাকে সৌন্দর্য মণ্ডিত এবং সুশোভিত করুন যে আমার কথা শুনলো এবং তা হেয় করলো। অতঃপর তা সেই ব্যক্তির নিকট পৌঁছালো যে তা শুনেনি …. ।
অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন :“আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির চেহারাকে সৌন্দর্য মণ্ডিত এবং সুশোভিত করুন যে আমার থেকে হাদীস শুনলো অতঃপর তা হেফ্য করে অন্যের নিকট পৌঁছালো… ।
আরেক বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন: “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির চেহারাকে সৌন্দর্য মণ্ডিত এবং সুশোভিত করুন যে আমার থেকে কিছু শুনলো অতঃপর সে তা সেভাবেই অন্যের নিকট পৌঁছালো যেভাবে তা শুনলো, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শারী’আতের বিধিবিধানের মধ্যে সংযোজন আর বিয়োজন করার কোন সুযোগ নেই। যদি সুযোগ থাকতো তাহলে যেভাবে শুনলো সেভাবে পৌঁছানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করে তিনি দু’আ করতেন না।
রসূল (স) অন্য হাদীসের মধ্যে তার সহাবীগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেন:“তোমরা সেগুলোকে হেফ্য করো আর সেগুলোর ব্যাপারে তোমাদের পেছনের (অনুপস্থিত) ব্যক্তিদেরকে সংবাদ দাও।” অন্য বর্ণনায় এসেছে : “সেগুলোকে পৌঁছে দাও)। হেফ্য করতে নির্দেশ দেয়া কিসের প্রমাণ বহন করে? এর অর্থ কি এই যে, আমি সমাজের মধ্যে আমার মনমত ভালো মনে করে কিছু চালু করে দেব। যদি তাই হতো তাহলে আর তিনি হেফ্য করতে বলবেন কেন? আর হেফ্য্ করতে বলার কোন উপকারিতাই বা থাকতো কি।
এ কারণে উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, কুরআন এবং হাদীসকে সংরক্ষণ এবং হেয় ও হেফাযাত করার জন্য রসূল (স) সহাবীগণকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে করে মু’মিনদের মাঝে সত্যিকারে তাঁর ইত্তিবা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য লাভ করা সম্ভব হয়।
নিম্নোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনাও প্রমাণ করে যে, রসূল (স) সহাবীগণকে যেভাবে শিখিয়েছেন অন্যদেরকে সেভাবেই শিখাতে হবে
আবূ সুলাইমান মালেক ইবনু হুঅইরিস হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: আমরা সমবয়সী কতিপয় যুবক নাবী (স) এর নিকট এসে তাঁর নিকট বিশ দিন অবস্থান করেছিলাম (তাদের এ অবস্থান ছিলো দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে)। এমতাবস্থায় তিনি রসূল (স) ধারণা করলেন যে, আমরা আমাদের পরিবারদেরকে কামনা করছি। তাই তিনি আমাদেরকে পরিবারের যাদেরকে রেখে এসেছি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তাঁকে
জানালাম। তিনি বন্ধুর মত এবং দয়ালু ছিলেন। অতঃপর তিনি আমাদেরকে বললেন : তোমরা তোমাদের পরিবারের নিকট ফিরে গিয়ে তাদেরকে শিখাও এবং তাদেরকে (পালন করতে) নির্দেশ প্রদান কর এবং তোমরা সেভাবেই সলাত আদায় কর যেভাবে তোমরা আমাকে সলাত আদায় করতে দেখছ। আর যখন সলাতের সময় উপস্থিত হবে তখন তোমাদের একজন যেন আযান দেয় এবং তোমাদের বড়জন যেন ইমামাত করে। “আলআদাবুল মুফরাদ’ (২১৩) ও “সহীহ্ নাসাঈ (৬৩৫)।
এ হাদীস আমাদেরকে কয়েকটি বিষয় শিক্ষা দেয় :
(১) শিক্ষকের নিকট হতে শিক্ষার জন্য সফর করা যাবে।
(২) ইসলাম প্রচারের জন্য আগে শিক্ষকের নিকট শিখতে হবে এরপর প্রচারের জন্য যেতে হবে।
(৩) শিখতে হবে নাবী (র) এর সুন্নাত মাফিক। অর্থাৎ তিনি যেভাবে শিখিয়েছেন ইসলাম শিখতে হবে সেভাবে। (উল্লেখ্য মনগড়া সময় নির্দিষ্ট করে মনগড়া পদ্ধতিকে শারী’আত বানিয়ে, ফাযীলাতের মনে করে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বের হওয়া যাবে না। যদি সময় নির্ধারণ করা শারী’আত সম্মত হতো তাহলে বিশদিন হওয়াই সঠিক হতো)।
(৪) নিজে শিখে এবং আগে নিজে আমল করে সর্বপ্রথম নিজ পরিবারের সদস্যদেরকে শিখাতে হবে। পরে অন্যদেরকে।
(৫) পরিবারের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে ইসলামী তরীকা। যেখানে শিক্ষক ছাত্রদের পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছেন, সেখানে ছাত্ররা তাদের নিজেদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজন মাফিক খোঁজ খবর নিবেন। আলোচ্য হাদীস ভাই শিক্ষা দেয়।
(৬) সহীহ্ হাদীসে যেভাবে সলাতের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে শুধুমাত্র সেভাবেই সলাত আদায় করতে হবে। অন্যথায় রসূল (স) এর নির্দেশের নাফারমানী করা হবে।
প্রিয় পাঠক! রসূল (স) তাঁর কোন কোন সাথীর জন্য নির্দিষ্ট করে দু’আও করেছেন যাতে তাকে দ্বীনের ফাকীহ্ বানিয়ে দেয়া হয়। যেমন তিনি আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস এর জন্য দু’আ করেছেন যে, “হে আল্লাহ্! তুমি তাকে দ্বীনের ফাকীহ্ (সমঝদার) বানিয়ে দাও ।
আলোচনা করার সময় প্রয়োজনে একটি কথা তিনবার করে বলতে হবে যাতে করে শ্রোতা সঠিকভাবে জেনে-বুঝে নিতে পারে কারণ আনাস ইবনু মালেক (র হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রসূল (স) যখন কোন কথা বলতেন তখন তিনি তা তিনবার করে বলতেন। যাতে করে কথাটি তাঁর থেকে বুঝে নেয়া যায়। * এর মানে এই যে, শিখানোর ক্ষেত্রে যাতে সঠিকভাবে শিখতে পারে এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে শিক্ষক বারবার বলবেন। দ্বীন শিখার ক্ষেত্রে এটিও একটি অনুসরণীয় নিয়ম। কারণ যেভাবে শিখানো হবে সেভাবে হেফ্য করাই হচ্ছে সুন্নাতী তরীকা মিম্নোক্ত হাদীস থেকে তারই প্রমাণ মিলে:
যেমন বারা ইবনু আযেব হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল (স) বলেনঃ তুমি যখন তোমার বিছানা গ্রহণ করার ইচ্ছা করবে, তখন তুমি সলাতের অযূর ন্যায় অযূ করো। অতঃপর ডান কাত হয়ে শুয়ে পড় এবং বল : ‘আল্লাহুম্মা আসলামতু অজহী ইলাইকা, অ ফাওঅয্যতু আমরী ইলাইকা, অ আলজাতু যহরী ইলাইকা, রাগবাতান অ রহ্বাতান ইলাইকা, লা মালজাআ অ লা মানজা ইন্না ইলাইকা, আমানতু বিকিতাবিকাল্লাযী আনযালতা, অবিনাবিয়্যিকাল্লাযী আরসালতা।’ এ বাক্যকেই তুমি তোমার শেষ কথা বানাও। কারণ তুমি যদি তোমার সে রাতে মারা যাও তাহলে তোমার মৃত্যু হবে ইসলামের উপর।
বারা ইবনু আযেব বলেন : এটিকে আমি নাবী (স) এর সামনে বারবার বলছিলাম। এ সময় আমি বললাম : ‘অ রসূলিকাল্লাযী আরসালতা’। তখন রসূল (3) বললেন : না, তুমি বল : অ নাবিয়্যিকাল্লাযী আরসালতা’ এ হাদীস আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, আমরা যখন কোন দু’আ পাঠ করব অথবা হাদীস বর্ণনা করব তখন রসূল (R) যেভাবে পাঠ করেছেন অথবা যেভাবে বর্ণনা করেছেন আমাদেরকেও সেভাবে পড়তে হবে এবং বলতে হবে।
কারণ রসূল (স) হতে বর্ণনা করতে গিয়ে যদি তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করা হয়ে যায় তাহলে বিপদ আছে এবং এ ব্যাপারে তিনি কঠোর ভাষায় সাবধানবাণীও উচ্চারণ করেছেন : আলী হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেনঃ নাবী (স) বলেন : “তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ করো না। কারণ যে আমার উদ্ধৃতিতে মিথ্যা বলবে সে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। ১৬
সালামাহ্ জিনা হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : আমি নাবী (স) কে বলতে শুনেছি যে, যে আমার উদ্ধৃতিতে এমন কথা বলবে যা আমি বলিনি অবশ্যই সে তার স্থান জাহান্নামের আগুনে বানিয়ে নিবে।
সামুরাহ ইবনু জুন্দুর এবং মুগীরাহ্ ইবনু শু’বাহ হতে বর্ণিত হয়েছে, তারা উভয়েই বলেন: রসূল (স) বলেছেনঃ “যে আমার উদ্ধৃতিতে হাদীস বর্ণনা করবে অথচ দেখা যাচ্ছে যে, তা মিথ্যা সে মিথ্যুকদের একজন। ১৮
মুগীরাহ্বলেন: আমি রসূল (এই)কে বলতে শুনেছি যে, “আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা অন্য কারো প্রতি মিথ্যারোপের মত নয়। কারণ যে আমার প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নামের আগুনকে বানিয়ে নিবে । ১৯
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! রসূল (স) উপরোক্ত হাদীসগুলো কি অনর্থক বলেছেন। সতর্ক করেছেন কি এমনিই। না, তা নয়। বরং তাঁর উদ্ধৃতিতে হাদীস বানানো হবে, তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করা হবে বলেই তিনি সতর্ক করে গেছেন এবং তিনি স্পষ্ট করেই বলে গেছেন যে, হাদীস তৈরি করা হবে।
আর এ কারণেই সাবধানতা অবলম্বন করে কোন কোন সহাবী হাদীস বর্ণনা করা ছেড়েই দিয়েছিলেন এ ভেবে যে, যদি রসূল (ক) যেভাবে বলে গেছেন সেভাবে বর্ণনাটা না হয়, যদি রসূল (স) যা বলে গেছেন তার বিপরীত হয়ে যায়। যেমন যুবায়ের ইবনুল আওওয়াম আমের ইবনু আব্দুল্লাহ্ ইবনু যুবায়ের (র হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তার পিতা (আব্দুল্লাহ্) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আব্দুল্লাহ) বলেন : আমি (পিতা) যুবায়েরকে বললাম (জিজ্ঞেস করলাম) : আমি আপনাকে রসূল (স) এর উদ্ধৃতিতে হাদীস বর্ণনা করতে শুনছি না যেমনভাবে অমুক আর অমুকে হাদীস বর্ণনা করছেন। তখন তিনি (উত্তরে) বললেন : অবশ্যই আমি তাঁর (রসূল হল) থেকে বিচ্ছিন্ন হতাম না। কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি “যে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে সে তার স্থান জাহান্নামের আগুনে বানিয়ে নিবে।
এ হাদীসের কারণে তার মধ্যে যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাই তাকে হাদীস বর্ণনা করতে বাধা প্রদান করেছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে শুনে শুনে এমনভাবে হাদীস বর্ণনা করা হচ্ছে যেন সবাই হাদীসের পণ্ডিত। আবার উদ্ধৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সহীহ্ গ্রন্থগুলোর নাম উল্লেখ করে বানোয়াট উদ্ধৃতিও দেয়া হচ্ছে। আপনি যদি ইন্টারনেটের গুলল সার্চ করেন, তাহলে দেখবেন শিরোনামে বলা হচ্ছেঃ … এ বিষয়ে বর্ণিত সহীহ্ হাদীসসমূহ, এরপরে ভিতরে ঢুকে দেখা যাচ্ছে বেশীরভাগই বানোয়াট। কিন্তু শিরোনাম দিয়ে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে!!! আসলে ইসলামকে ভেজালযুক্ত করার জন্য শয়তান কতভাবে আর কতরূপে যে আগমন করে তা বলা বড়ই মুশকিল।
একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, অহী দু’প্রকারের : (১) আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া অহী, এটি আবার দু’প্রকারের পঠিত অহী অর্থাৎ কুরআন আর অপঠিত অহী অর্থাৎ হাদীস। (২) শয়তানের পক্ষ থেকে তার অনুসারীদের নিকট আগত অহী। যেমন বানোয়াট হাদীস, শির্ক ও কুফর সম্বলিত এবং সংমিশ্রিত বানোয়াট কেস্সা কাহিনী, হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল বানিয়ে ফাতওয়া প্রদান এবং বিদ’আতকে সুন্নাত বানিয়ে দেয়া ইত্যাদি। দেখুন আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন কি বলেছেন: “আর (যবহ করার সময়) যাতে আল্লাহ্র নাম নেয়া হয়নি তা তোমরা খাবে না, তা হচ্ছে পাপাচার, শায়ত্বানরা তাদের বন্ধুদের নিকট অহী করে যাতে তারা তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া-বিতর্কে লিপ্ত হয়; এমতাবস্থায় তোমরা যদি তাদের কথার অনুসরণ করো তাহলে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে।” “সূরাহ্ আল আন’আম ” (১২১)। এ থেকে বুঝা গেলো যে, শয়তান এবং তাদের অনুসরণকারীদের অনুসরণ করা হচ্ছে শির্কের অন্তর্ভূক্ত।
আর কোন সন্দেহ নেই যে, শয়তানের অহীর অনুসরণকারীদের সংখ্যা হবে বেশী। আর তাদের সংখ্যাধিক্যতা দেখে বিচলিত হওয়ার কারণও নেই। কারণ রসূল (স) এক হাদীসের মধ্যে বলেছেন: আব্দুল্লাহ্ ইবনু আর এ হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : রসূল (স) বলেছেন: গোরাবাদের জন্য সুসংবাদ। আমরা বললাম ( জিজ্ঞেস করলাম) : গোরাবা কারা? তিনি (উত্তরে) বললেনঃ বহু মন্দ লোকের মধ্যে তারা কমসংখ্যক এক নেককার সম্প্রদায়। যারা তাদের (অল্প সংখ্যক নেককারদের) নাফারমানী করবে এদের সংখ্যা হবে বহু বেশী, তাদের (নেককারদের) অনুসরণকারীদের চেয়ে। দেখুন “মুসনাদু আহমাদ ” (৬৬৫০, ৭০৭২), “মুসনাদু ইবনুল মুবারাক” (২৩), “আলমু’জামুল কাবীর” (১৪৫৭) ও “আলমু’জামুল আওসাত” (৮৯৮৬)। হাদীসটি সহীহ্ দেখুন “সিলসিলাহ্ সহীহাহ্” (১৬১৯), “সহীহ্ তারগীব অতারহীব” (৩১৮৮) ও “সহীহুল জামে’উস সাগীর (৩৯২১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে : “… জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! তারা কারা? তিনি (উত্তরে) বললেনঃ “ওরা তারাই- লোকেরা যখন (দ্বীনী শিক্ষার ক্ষেত্রে) নষ্ট (পথহারা) হয়ে যাবে তখন যারা তাদেরকে সংশোধন করবে।” দেখুন “মুসনাদু আহমাদ” (১৬৬৯০/১৬৭৩৬), “মুসনাদু ইবনুল মুবারাক” (২৩), “আলমু’জামুল কাবীর” (৭৬৫৯) ও “আলমু’জামুল আওসাত” (৩০৫৬) ও আলমু’জামুল আওসাত” (২৯০)। এ হাদীসটিও সহীহ্। দেখুন “সিলসিলাহ্ সহীহাহ্” (১২৭৩)।
অতএব হক্বপন্থীদের সংখ্যা হবে সর্বদাই কম। দেখুন ইব্রাহীম (আঃ) একা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একা এক উম্মাত। “সূরা আননাহাল 120 ) । আবার হাদীসে বর্ণিত হয়েছে মুসলিমদের তেহাত্তর দলের মধ্যে জান্নাতে যাবে মাত্র একটি দল আর সেটি হচ্ছে ‘জামা’আত’। “সহীহ্ আবী দাউদ” ( ৪৫৯৭), “সহীহ্ জামেউস সাগীর” (২০৪২, ২৬৪১) ও “সিলসিলাহ্ সহীহাহ্” (২০৪)।
এ ‘জামা’আত’ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এর ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ বলেন : ‘অধিকাংশ লোক জামা’আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আর জামা’আত হচ্ছে সেটিই যার হজ্বের সাথে মিল ঘটেছে যদিও তুমি একা হও।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন: ‘জামা’আত সেই যে হক্কের উপর রয়েছে যদিও তুমি একা হও।’ দেখুন “আলখুলাসাতু ফিল আকারিয়্যাত” (২/৯০, ১০৫)।
অতএব জামা’আত সেই যার অবস্থান সহীহ্ দলীল নির্ভর তরীকার উপর- যদিও সে একা হয়। সহাবীগণের উদ্ধৃতিতে রসূল (স) এর হাদীস বা সহাবীর বাণী বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও সহাবী এবং তাবেঈগণ থেকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে :
ব্যক্তিকে রসূল (ই) হতে বর্ণিত হাদীসকে, কা’ব হতে বর্ণনাকৃত বানিয়ে ফেলতে শুনতাম, আবার কাবের উদ্ধৃতিতে বর্ণিত আসারকে রসূল (এই) এর উদ্ধৃতিতে বর্ণনাকৃত বানিয়ে ফেলতে শুনতাম।
উমার (র) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : (ভাবার্থ) তার উদ্ধৃতিতে জেনে- বুঝে ভালোভাবে হেফ্য করে যে ব্যক্তি (তার কোন কথা) বর্ণনা করতে সক্ষম সেই বর্ণনা করবে, আর যে তা হেফ্য করতে না পারার ভয় করবে, আমি এরূপ কাউকে আমার উপর মিথ্যারোপ করার বৈধতা দেব না। রসূল (স) সহাবীগণকে হাদীস লিখার অনুমতি প্রদান করেন
পাঠকবৃন্দ! নাবী (র) তাঁর সহাবীগণকে ইসলামের প্রথম যুগে হাদীস লিখতে নিষেধ করেছিলেন। এ আশঙ্কায় যে, কুরআনের সাথে মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে অথবা এ আশঙ্কায় যে, লোকেরা কুরআন ছেড়ে হাদীস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। অতঃপর তিনি যখন সংমিশ্রণ না হওয়ার এবং কুরআন ছেড়ে শুধুমাত্র হাদীস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই মনে করেন তখন তাদেরকে সুন্নাতগুলোও (হাদীসগুলোও) লিখার অনুমতি প্রদান করেন।
বুকায়ের ইবনু আশুয় হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন আমাদেরকে বু ইবনু সাঈদ (তিনি বড় তাবেঈগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) বলেন : তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন কর (অথবা হাদীস বর্ণনা করা হতে বিরত থাক)। আল্লাহর কসম। তুমি আমাদেরকে দেখেছো আবূ হুরাইরাহ্ এর নিকট বসতাম, তিনি আমাদের কাছে রসূল (স) এর উদ্ধৃতিতে হাদীস বর্ণনা করতেন আবার কা’ব হতেও বর্ণনা করতেন। অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে চলে) যেতেন। এরপর আমাদের সাথে যারা থাকতো তাদের মধ্য থেকে কোন কোন এ মর্মে আব্দুল্লাহ্ ইবনু আমর ইবনুল আস হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন : আমি হেফ্য করার ইচ্ছায় রসূল (স) হতে যা কিছুই শুনতাম তার সবই লিখতাম। কিন্তু কুরাইশরা আমাকে নিষেধ করে বলল : তুমি যা কিছু শোন তার সবই লিখছ অথচ রসূল (স) মানুষ, রাগ করে কথা বলেন আবার স্বাভাবিক অবস্থাতেও কথা বলেন? এ কারণে আমি লিখা বন্ধ করে দিয়ে রসূল (স) এর নিকট তা উপস্থাপন করলাম। তখন তিনি তাঁর আঙ্গুল দ্বারা স্বীয় মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : তুমি লিখ, সেই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার আত্মা, তা থেকে হক্ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
অনুবাদের মধ্যে বর্ণিত বিভিন্ন ভাষ্য ও উক্তি বুঝার জন্য পাঠকবৃন্দের যা জানা একান্ত অপরিহার্য
হাদীস শাস্ত্রের বিধান সম্পর্কীয় যে সব বাক্যের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা জানা যরূরী, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদান করা হল :
১। মুতাওয়াতিরঃ সেই হাদীসকে মুতাওয়াতির বলা হয় যেটিকে সংখ্যায় এ পরিমাণ বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন যে, তাদের পক্ষে সাধারণত মিথ্যার উপর একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়। এরূপ; বাক্য ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই হতে পারে যাকে বলা হয় ‘মুতাওয়াতির লাবী’। যেমন
এটিকে সত্তরের অধিক সহাবী বর্ণনা করেছেন।
আবার শুধুমাত্র অর্থের দিক দিয়েও হতে পারে। যেমন মুযার উপর মাসাহ করা এবং কবরের আযাব সংক্রান্ত হাদীস। এটিকে বলা হয় মুতাওয়াতিরু মা’নাবী।
২। খবর ওয়াহিদঃ আভিধানিক অর্থে সেই হাদীসকে বলা হয় যেটিকে একজন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন। আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসকে খবর ওয়াহিদ বলা হয় যার মধ্যে মুতাওয়াতির হাদীসের শর্তাবলী একত্রিত হয়নি।
এই খবর ওয়াহিদ তিন প্রকার :
(ক) মাশহুর ও আভিধানিক অর্থে যে হাদীস মানুষের মুখে মুখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যদিও সেটি মিথ্যা হয় সেটিকেই মাশহুর বলা হয়।
আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসটিকে মাশহুর বলা হয় যেটি তিন বা ততোধিক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন। তবে তার (মাশহুর) স্তরটি মুতাওয়াতিরের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেনি।
(খ) আযীয ও সেই হাদীসকেই বলা হয় যার সনদের প্রতিটি স্তরে দুইজন করে বর্ণনাকারী রয়েছে।
(গ) গাৱীৰ: যে হাদীসের সনদের কোন এক স্তরে মাত্র একজনে বর্ণনা করেছেন সে হাদীসটিকেই বলা হয় গারীব হাদীস। যেমন বুখারী প্রমুখ গ্রন্থে বর্ণিত নিয়ত সংক্রান্ত এ হাদীসটি।
৩। মারফূ’ : নাবী (স)-এর কথা, বা কাজ, বা সমর্থনকে বলা হয় ‘মারফূ’ शमী ।
৪। মওকৃষ্ণ সহাবীর কথা, বা কর্ম, বা সমর্থনকে বলা হয় ‘মওকৃষ্ণ’।
৫। মাকতু’ তাবে’ঈ বা তার পরের কোন ব্যক্তির কথা বা কাজকে বলা হয় ‘মাকতূ’।
৬। মুসনাদ: যে হাদীসের সনদ (কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই) নাবী (স) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে বলা হয় ‘মুসনাদ’।
৭। মুত্তাসিল: যে মারফু’ বা মওকৃষ্ণ-এর সনদটিতে কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতা নেই তাকেই বলা হয় ‘মুত্তাসিল’।
৭। সহীহ যে হাদীস সনদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং পূর্ণাঙ্গ আয়ত্ত্বশক্তি ও হেফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় ‘সহীহ হাদীস’। এটিকে ‘সহীহ লি বাতিহি’ও বলা হয়।
৮। হাসান: যে হাদীস সনদের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং কিছুটা ত্রুটিযুক্ত আয়ত্ত্বশক্তি ও হেফযের গুণাবলী সম্বলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে তাকেই বলা হয় ‘হাসান হাদীস’। এটিকে ‘হাসান লি যাতিহি’ও বলা হয়।
৯। সহীহ লি গায়ৱিহি (অন্যের কারণে সহীহ) : এটি মূলত হাসান লি যাতিহি। কিন্তু হাসানের একাধিক সূত্র পাওয়া গেলে, সে সময় হাসান হতে সহীহার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি ‘সহীহ লি যাতিহি’র চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের।
১০। হাসান লি পায়রিহি (অন্যের কারণে হাসান): এটি মূলত দুর্বল হাদীস। কিন্তু যখন তা একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয় এবং হাদীসটির বর্ণনাকারী ফাসেক বা মিথ্যার দোষে দোষী হওয়ার কারণে দুর্বল না হয়, তখন এটি অন্যান্য সূত্রগুলোর কারণে ‘হাসান’-এর পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। তবে এর স্তরটি “হাসান লি যাতিহি’র চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের।
১১। যইফ ও যে সনদে হাসান হাদীসের সনদের গুণাবলী একত্রিত হয়নি, হাসান-এর সনদের শর্তগুলোর যে কোনটি অনুপস্থিত থাকার কারণে, সে সনদের হাদীসটিকে ‘যঈফ’ বলা হয়।
এই ‘য’টফে’র স্তরগুলো বিভিন্ন হতে পারে বর্ণনাকারীর মাঝের দুর্বলতা (ত্রুটি) কম বেশী হওয়ার কারণে। (যেমনভাবে সহীহ হাদীসের স্তরে পার্থক্য রয়েছে বর্ণনাকারী নির্ভরশীল বা বেশী নির্ভরশীল হওয়ার কারণে)। দুর্বলের প্রকার গুলোর মধ্যে রয়েছে, য’ঈফ, যঈফ জিন্দান (নিতান্তই দুর্বল), ওয়াহিন, মুনকার, মুখতারিব, মু’খাল, মুরসাল মু’আল্লাক ইত্যাদি। তবে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রকার হচ্ছে মাওযূ’ (জাল)।
১২। মু’আল্লাক ঃ যে হাদীসের সনদের শুরুতে একজন বা পর্যায়ক্রমে একাধিক বর্ণনাকারী উল্লেখ করা হয়নি সেই হাদীসকে ‘মু’আল্লাক’ বলা হয়। যেমন সনদের সকল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ না করে এরূপ বলা যে, রসূল (স) বলেছেন, কিংবা সহাৰী বা তাবেঈ ছাড়া সনদের সকল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ না করা। এ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
১৩। মুরসাল : যে সনদের শেষ ভাগে ভাবেঈর পরের ব্যক্তি অর্থাৎ সহাবীকে উহ্য রেখে তাবেঈ বলবেন রসূল (স) বলেছেন। এরূপ সনদের হাদীসকে মুরসাল বলা হয়। এরূপ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়।
১৪। মু’খাল : যে সনদে দুই বা ততোধিক বর্ণনাকারীকে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়নি সেই সনদের হাদীসকে বলা হয় মু’খাল। এরূপ হাদীস দুর্বলের পর্যায়ভুক্ত, গ্রহণযোগ্য নয়।
১৫। মুনকাতি ঃ যে হাদীসের সনদে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে তাকেই বলা হয় “মুনকাতি”। এ বিচ্ছিন্নতা যেভাবেই হোক না কেন। মুরসাল, মু’আল্লাক, মুখাল এসব গুলো এরই অন্তর্ভুক্ত। সনদের মধ্যে অজ্ঞতা থাকার কারণে এটি সকল আলেমের ঐকমত্যে দুর্বল হাদীসের অন্তর্গত।
১৬। মাতরূক : সেই হাদীসকে বলা হয় যার সনদে মিথ্যার দোষে দোষী বর্ণনাকারী রয়েছে। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
১৭। মা’রুফ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী কর্তৃক দুর্বল বর্ণনাকারীর বিরোধিতা করে বর্ণনা করাকেই বলা হয় ‘মা’রূফ’ হাদীস। মারুফ হাদীস গ্রহণযোগ্য।
১৮। মুনকার ও দুর্বল বর্ণনাকারী কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বিরোধিতা করে বর্ণনা করাকেই বলা হয় মুনকার হাদীস। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্য ভাষায় মুনকার বলা হয় সেই হাদীসকে যার সনদে এমন এক বর্ণনাকারী আছেন যার বেশী ভুল হয় বা যার অসতর্কতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিংবা পাপাচার প্রকাশ পেয়েছে।
১৯। মাহফুয: যে হাদীসটি বেশী নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তার চেয়ে কম নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির বিরোধিতা করে বর্ণনা করেছেন তাকে বলা হয় ‘মাহফু’ হাদীস। এ হাদীস গ্রহণযোগ্য।
২০। শাখ: যে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তার মতই একাধিক বা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির বিরোধিতা করে বর্ণনা করেছেন সেটিকে বলা হয় ‘শা’। এরূপ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
২১। মাজল : যে বর্ণনাকারীর সত্ত্বা বা গুণাবলী (অবস্থা) সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না তাকেই বলা হয় ‘মাজহুল’। এরূপ বর্ণনাকারীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
২২। জাহালাত: যে সনদের মধ্যের কোন বর্ণনাকারীর সত্ত্বা বা অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না সে সনদটিকে জাহালাত (অজ্ঞতা) সম্বলিত সনদ বলা হয়।
২৩। ভাবে সেই হাদীসকে ভাবে বলা হয় যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বাক্য এবং অর্থের দিক দিয়ে অথবা শুধু অর্থের দিক দিয়ে এককভাবে হাদীস বর্ণনাকারীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে একই সহাবা হতে।
২৪। শাহেদ সেই হাদীসকে শাহেদ বলা হয় যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বাক্য এবং অর্থের দিক দিয়ে অথবা শুধু অর্থের দিক দিয়ে এককভাবে হাদীস বর্ণনাকারীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে ভিন্ন সহাবা হতে।
২৫। মুতাৰা’য়াত ও হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারী অন্য বর্ণনাকারীর সাথে মিল রেখে বর্ণনা করলে তাকে বলা হয় ‘মুতাবা’য়াত’। এটি দু’প্রকার :
(ক) মুতাবা’য়াতু তাম্মাহ যদি সনদের প্রথম অংশের বর্ণনাকারীর স্থলে অন্য বর্ণনাকারী মিলে যায়, তাহলে তাকে ‘মুতাবা’য়াতু তাম্মাহ’ বলে।
(খ) মুতাবা’য়াতু কাসিরা যদি সনদের মাঝের কোন বর্ণনাকারীর স্থলে অন্য কোন বর্ণনাকারী মিলে যায় তাহলে তাকে বলা হয় ‘মুতাবা’য়াতু কাসিরা’।
২৬। মুদাল্লাস : সনদের মধ্যের দোষ লুকিয়ে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ করে বর্ণনা করা হাদীসকে ‘মুদাল্লাস’ বলা হয়। আর যে ব্যক্তি এরূপ করে তাকে বলা হয় ‘মুদাল্লিস’ (দোষ গোপণকারী)।
তাদলীস (সনদের দোষ গোপন করা) দু’প্রকার :
(ক) তাদলীসুল ইসনাদ রাবী (বর্ণনাকারী) কর্তৃক তার শাইখকে লুকিয়ে তার শাইখের শাইখ হতে অথবা তার সমসাময়িক অন্য কোন ব্যক্তি হতে বর্ণনা করা, যার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে, কিন্তু তার থেকে সে শ্রবণ করেনি।
(খ) তাদলীসুত তাসবিয়া: রাবী কর্তৃক এমন এক দুর্বল বর্ণনাকারী হতে হাদীস বর্ণনা করা, সনদে যার অবস্থান এমন দুই নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মাঝে যারা একে অপরের সাথে মিলিত হয়েছে। অতঃপর রাবী কর্তৃক সেই দুর্বল বর্ণনাকারীকে কুপিয়ে তার নির্ভরযোগ্য শাইখের মাধ্যমে অপর নির্ভরযোগ্য হতে বর্ণনা করা। (অথচ ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দিয়ে উভয়ের মাঝের দুর্বল বর্ণনাকারীকে উল্লেখ করা উচিত ছিল)। এটি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্টতম তাদলীস।
* তাদলীসুশ শখ: রাবী কর্তৃক মানুষের নিকট তার শাইখের অপ্রসিদ্ধ নাম বা কুনিয়াত বা উপাধি ইত্যাদি উল্লেখ করার মাধ্যমে হাদীস বর্ণনা করা মুদাল্লিস বর্ণনাকারী যদি স্পষ্ট ভাষায় শ্রবণ সাব্যস্ত করে, যেমন বলবে আমি শুনেছি, তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি স্পষ্টভাবে তার শ্রবণ সাব্যস্ত না করে,(যেমন বলবে অমুক হতে অমুক হতে, যেটাকে বলা হয় আন্ আবূ করে) তাহলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে না।
২৭। মুরসালুল খাফী: রাবী কর্তৃক তার সমসাময়িক এমন ব্যক্তি হতে হাদীস বর্ণনা করা যার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটার ব্যাপারটি জানা যায় না।
২৮। মাওযূ’; নিজে জাল করে রসূল (স)-এর উপর মিথ্যারোপ করাকেই “মাওযূ” হাদীস বলা হয়। (এরূপ বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করা হারাম)।
২৯। মুখতারিব : আভিধানিক অর্থে মুখতারিব বলা হয় কর্মে রুটিযুক্ত হওয়াকে। আর পারিভাষিক অর্থে সেই হাদীসকে মুখতারিব বলা হয়, যেটি সমশক্তিতে বিভিন্ন রূপে বর্ণিত হয়েছে। যার একটি অন্যটির সাথে সাংঘর্ষিক এবং একটিকে অন্যটির সাথে একত্রিত করেও আমল করা সম্ভবপর হয় না। এরূপ বিভিন্নতা সনদের বর্ণনাকারীদের নাম নিয়েও হতে পারে আবার হাদীসের ভাষাতেও হতে পারে। তবে এরূপ সনদের মধ্যেই বেশী ঘটে থাকে। এরূপ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
৩০। মুসাহাফ : আভিধানিক অর্থে তাসহীফ বলা হয় লিখতে এবং পড়তে ভুল করাকে। পারিভাষিক অর্থে মুসাহাফ বলা হয় শব্দ অথবা অর্থের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্যদের বর্ণনার বিরোধিতা করে হাদীসের শব্দে পরিবর্তন ঘটানোকে। তাসহীফ সংঘটিত হয় সনদ এবং মাতান (হাদীসের ভাষা) উভয়ের মধ্যে। সাধারণত শিক্ষক বা শাইখের নিকট শিক্ষা গ্রহণ না করে গ্রন্থরাজী হতে হাদীস গ্রহণকারী রাবী তাসহীফ-এর মধ্যে পতিত হয়ে থাকেন। হাফিয ইবনু হাজারের (رحمه الله) নিকট মুসাহাফ বলা হয়; নির্ভরযোগ্যদের বর্ণনার বিরোধিতা করে হাদীসের সনদে ব্যক্তির নামের বা হাদীসের ভাষার কোন শব্দের অক্ষরের এক বা একাধিক নুকতাকে শব্দের আকৃতি ঠিক রেখে পরিবর্তন করাকে।
৩১। মুদরাজ: আভিধানিক অর্থে কোন বস্তুকে অন্য কোন বস্তুর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়াকেই বলা হয় ‘মুদরাজ’ বলা হয়। আর পারিভাষিক অর্থে মুদরাজ বলা হয় সনদের মাঝে কারণ বশতঃ বর্ণনাকারীর পক্ষ হতে কোন কিছু সংযোজন করাকে অথবা হাদীসের ভাষ্যে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় এরূপ কিছুর প্রবেশ ঘটিয়ে তার সাথে মিশিয়ে দেয়াকে (পৃথকভাবে উল্লেখ না করে)। মুদরাজ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং হারাম। তবে যদি ব্যাখ্যা মূলক হয় তাহলে তা নিষিদ্ধ নয়।

যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ৪র্থ খণ্ড
Reviews
There are no reviews yet.