তাফসীর আহসানুল বায়ান
তাফসীর আহসানুল বায়ান
সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদের বিশুদ্ধ তাফসীরের সহজবোধ্য ও মানসম্মত বাংলা অনুবাদ তাফসীর আহসানুল বায়ান। এটি রচনা করেন শাইখ সালাহুদ্দিন ইউসুফ; আর বাংলা অনুবাদের তত্ত্বাবধান ও সম্পাদনা করেছেন আল-মাজমা‘আহ দাওয়া সেন্টারের সম্মানিত দা‘ঈ শাইখ আব্দুল হামীদ ফাইযী আল-মাদানী সাহেব।
– উর্দু তাফসীর আহসানুল বায়ান সম্পাদনা করেছেন রাহীকুল মাখতুমের বিশ্বখ্যাত লেখক শাইখ সফিউর রহমান আল-মুবারকপুরীসহ বেশ কয়েকজন আলেম; যা পরবর্তীতে মদীনাস্থ বাদশা ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস কর্তৃক প্রিন্ট হয়েছে।
– তাফসীর আহসানুল বায়ান উর্দু ভাষায় প্রথম ছাপা হয়েছিল সুবিখ্যাত দারুস সালাম লাইব্রেরীর তত্ত্বাবধানে। তাদের কাছ থেকে বঙ্গানুবাদ ও ছাপার অনুমতি নিয়ে বাংলাভাষী সাউদী বিভিন্ন দাওয়া সেন্টারে কর্মরত বেশ কয়েকজন দা‘ঈ অনুবাদ কর্মটি সম্পন্ন করেন। তারা হলেন,
শাইখ সফিউর রহমান রিয়াযী, মারাত দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
শাইখ মুহাম্মাদ হাশেম মাদানী, আয-যুলফী দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
শাইখ মুহাম্মাদ ইসমাঈল মাদানী, রুমাহ দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ ।
শাইখ যাকির হোসেন মাদানী, রাবওয়াহ দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
শাইখ মুসলেহুদ্দীন বুখারী, হুরাইমালা দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
শাইখ শামসুজ্জোহা রহমানী, তুমাইর দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
শাইখ হাবীবুর রহমান ফাইযী, আল-মাজমা‘আহ দাওয়া সেন্টারের দা‘ঈ।
তাফসীর আহসানুল বায়ান
[ ১ খণ্ডে সমাপ্ত ]
মূল :
‘আল্লামা হাফিয সালাহুদ্দীন ইউসুফ
তাফসীর অনুবাদে :
শায়খ সফিউর রহমান রিয়াযী
শায়খ মুহাম্মাদ হাশেম মাদানী
শায়খ মুহাম্মাদ ইসমাঈল মাদানী
শায়খ যাকির হোসেন মাদানী
শায়খ মুসলেহুদ্দীন বুখারী শায়খ
শামসুজ্জোহা রহমানী
শায়খ হাবীবুর রহমান ফাইযী
সম্পাদনায় :
আব্দুল হামীদ ফাইযী আল-মাদানী
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ইসলামী গবেষক, লেখক, মুহাক্কিক আলিম ও দাঈ
ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সঊদী আরব
প্রকাশনায়
তাওহীদ পাবলিকেশন্স
ঢাকা-বাংলাদেশ
শুরুর কথা
الحمد لله رب العالمين، القائل في كتابه المبين : { قَدْ جَا۬ءَکُمْ مِّنَ اللہِ نُوْرٌ وَّکِتٰبٌ مُّبِیْنٌ} والصلاة والسلام على أشرف الأنبياء والمرسلين، نبينا محمد القائل: (خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ). وبعد:
মহান আল্লাহর মহাগ্রন্থ আল-ক্বুরআন মানুষের জন্য জীবন-সংবিধান ও সৎপথের দিশারী। প্রত্যেক মানুষের কাছে এর গুরুত্ব কোনক্রমেই কম নয়; তা জানুক মানুক অথবা না। মহানবী @-এর নির্দেশ “আমার নিকট থেকে পৌঁছে দাও; যদিও একটি আয়াত হয়” অনুসারে এই মহাগ্রন্থের তাবলীগ, প্রচার ও নানাভাবে খিদমত উলামাগণের এক মহান কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেকে কৃতার্থ হয়েছেন। অনেকে অনেক ভুল-ভ্রান্তির শিকারও হয়েছেন। আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যকে সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত করা মোটেই সহজ কাজ নয়। এই জন্য উলামাগণ বলেন, আল-ক্বুরআনের বাণীকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা মোটেই সম্ভব নয়। অবশ্য তার ভাবার্থ করা যেতে পারে, আর তারই প্রচেষ্টা যুগে যুগে।
তফসীর অনেক আছে; কিন্তু সহীহ নির্ভরযোগ্য সালাফী তফসীর কম। তাই এই মহতি খিদমতের ময়দানে পিছনে পড়ে থাকতে মন তুষ্ট হলো না। সঊদী আরবে কর্মরত দ্বীনের দায়ীদের কাছে প্রস্তাব রাখলাম বাংলা তফসীর প্রকাশ করার। নির্ভরযোগ্য সালাফী তফসীর মওলানা সালাহুদ্দীন ইউসুফ সাহেবের ‘তাফসীর আহসানুল বায়ান উর্দু ভাষায় ‘কিং ফাহাদ হোলি ক্বুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স’ মদীনা নববিয়া হতে প্রকাশিত, সেটির বঙ্গানুবাদ হলেই যথেষ্ট। তাতে মেহনত কম হবে, পদস্খলনও ঘটবে না ইনশা আল্লাহ। কিন্তু অনেকের নিকট এ প্রস্তাব মনঃপূত হলো না। পক্ষান্তরে কিছু উলামা এ কাজে সহযোগিতা করবেন বলে বিপুল আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদর্শন করলেন। উৎসাহদানে প্রধান ভূমিকা নিলেন ভাই শহীদুল্লাহ মিযী সাহেব। উদ্বুদ্ধ করলেন আল-মাজমাআহ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালকবৃন্দ। সুতরাং আল্লাহর নামে কাজ শুরু হল।
মওলানা মোবারক করীম জওহর সাহেব, ডক্টর মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান সাহেব এবং তওহীদ ট্রাস্ট কিষাণগঞ্জ কর্তৃক অনূদিত বাংলা ক্বুরআন সামনে রেখে সম্পাদনা শুরু করলাম। উর্দু তফসীর অনুবাদে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করলেন শায়খ মুহাম্মাদ হাশেম মাদানী (যুলফী ইসলামিক সেন্টার)। সেই সাথে যোগ দিলেন:-
২. শায়খ সফিউর রহমান রিয়াযী সাহেব (মারাত ইসলামিক সেন্টার)
৩. শায়খ মুসলেহুদ্দীন বুখারী সাহেব (হুরাইমালা ইসলামিক সেন্টার)
৪. শায়খ মুহাম্মাদ ইসমাঈল মাদানী সাহেব (রুমাহ ইসলামিক সেন্টার)
৫. শায়খ যাকির হোসেন মাদানী সাহেব (রাবওয়াহ ইসলামিক সেন্টার)
৬. শায়খ শামসুজ্জোহা রহমানী সাহেব (তুমাইর ইসলামিক সেন্টার)
৭. শায়খ হাবীবুর রহমান ফাইযী সাহেব (মাজমাআহ ইসলামিক সেন্টার)
সম্পাদনা ও সংশোধন কাজ শেষ করে ‘ কম্পিউটার ভিলেজ’ প্রোপাইটার জনাব মাহবুব সাহেবের কাছে পেশ করলে তিনি তাঁর বাণিজ্যিক ব্যস্ততার মাঝেও ‘কম্পিউটার পেজ’ তৈরী করে দেন।
শেষ সংশোধনের জন্য যাঁরা প্রুফ দেখে দিয়েছেন, তাঁদের জন্য আমাদের তরফ থেকে শুকরিয়া ও দুআ রইল।
আল্লাহ সকলকে ইখলাসের তওফীক দিন এবং এই পরিশ্রমের উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।
একাধিক লেখকের লেখা হলেও তা প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ইসলামী পরিভাষা তথা প্রচলিত উর্দু-আরবী শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই রকম পরিভাষা কিছু নিম্নরূপ:-
কুরআন একটি মহাগ্রন্থ। তার সবদিক তুলে ধরে আলোচনা করা মোটেই সহজ নয়; বিশেষ করে যেখানে কলেবর বৃদ্ধির ভয় থাকে এবং সংক্ষেপ উদ্দেশ্য থাকে, সেখানে তো আরো নয়। তবুও জরুরী দিক আলোচিত হয়েছে এই তফসীরে। সকল সূরা বা আয়াতের ‘শানে নুযূল’ (অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট) ও ফযীলত উল্লেখিত হয়নি। যেগুলি সহীহভাবে প্রমাণিত কেবল সেগুলিই উল্লেখ করেছেন লেখক। আর এই জন্যই এ তাফসীর আহসানুল বায়ান তফসীরে সকল পিপাসা মিটবে না পাঠকের। তবুও প্রয়োজনে কোথাও কোথাও ইঙ্গিতসহ কিছু কিছু জরুরী কথা সংযোজন করা হয়েছে। পাঠক সহজেই তা বুঝতে পারবেন। একই বিষয়ীভূত আয়াতের তফসীর এক স্থানে উক্ত হলে অন্য স্থানে তা পুনরুক্ত করা হয়নি। সে ব্যাপারে মূল উর্দুতে কোথাও অন্য আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবার কোথাও হয়নি। তাতে একজন আলেমের জন্য কোন অসুবিধা হবে না; কিন্তু সাধারণ পাঠকের জন্য সত্যই অসুবিধা হওয়ার কথা। সে জন্য আমরা দুঃখিত।
এক নজরে কুরআন মাজীদ
কুরআন মানে: পড়া। যেহেতু এ গ্রন্থ পড়বার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে এবং বারবার পড়া হয় তাই এর নাম হয় কুরআন।অথবা কুরআন মানে: একত্রিত করা। যেহেতু ক্বুরআনে শরীয়তের বিধান, ইতিহাস ও উপদেশ আদি একত্রিত হয়েছে, তাই এর নাম কুরআন হয়। পরিভাষায় কুরআন হল সেই অলৌকিক বাণীসমষ্টির কিতাব ও গ্রন্থের নাম, যা মহান আল্লাহ নিজ বান্দাদেরকে পথ দেখানোর জন্য জিবরীল (عَلَيْهِ السَّلاَمُ) মারফৎ মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর পর্যায়ক্রমে তাঁর ২৩ বছর জীবনে অবতীর্ণ করেন।
কুরআন সর্বপ্রথম ‘লওহে মাহফূয’ -এ লিপিবদ্ধ হয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সেখান থেকে বায়তুল ইয্যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমযানের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত্রি শবেকদরে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ করেন। তারপর জিবরীল আমীন (عَلَيْهِ السَّلاَمُ) দ্বারা প্রয়োজন মত প্রত্যেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ বছরে মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর কিছু কিছু করে অবতীর্ণ হয়। (মতান্তরে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআন সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ হয় এবং তা প্রথম শুরু হয় রমযান মাসে শবেকদরের রাত্রিতে। ) অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তিনি তা স্মৃতিস্থ করতে সক্ষম হন। অতঃপর সাহাবাদেরকে পড়ে শুনান। অহী লেখক সাহাবীগণ তা বিভিন্ন চামড়া ইত্যাদির পত্রে লিখে নেন। প্রথম খলীফা আবূ বাক্কর সিদ্দীক (র:) তা জমা করেন। তৃতীয় খলীফা উষমান বিন আফ্ফান গ্রন্থাকারে সংকলন করেন। এই সংকলন এখনো মস্কোর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। শুরুতে কুরআনে নুক্বত্বাহ ছিল না। কুরআনে নুক্বত্বাহ লাগিয়েছেন, আবুল আসওয়াদ দুআলী। যেমন তাতে হরকত (যের-যবর-পেশ)ও ছিল না। তাতে সর্বপ্রথম হরকত প্রয়োগ করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। কুরআন মাজীদের প্রত্যেক আয়াত এবং প্রত্যেক সূরার তরতীব (অনুক্রম) তাওকীফী (প্রমাণ-সাপেক্ষ). তা অবতরণের ধারাবাহিক ইতিহাস বা তারীখ অনুসারে বিন্যস্ত করার অধিকার কারো নেই।
‘কুরআন মাজীদ ধারাবাহিকভাবে লিখিত কোন গ্রন্থ নয়। লিখিত আকারে অবতীর্ণও হয়নি কুরআন আযীয। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই তার অবতারণা। তাই তাতে একটা ঘটনা কুরআন মাজীদ একটি নির্ভুল গ্রন্থ। এ গ্রন্থে কোন প্রকারের সন্দেহ নেই। এতে কোন প্রকার বাতিলের সংমিশ্রণ নেই। এই অপরিবর্তনীয় ও অপরিবর্ধনীয় অবস্থায় কুরআন কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এ পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে।
কুরআন কারীম মানব জীবনের পরিপূর্ণ জীবন-সংবিধান। বৈয়াক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সহ সকল প্রকার কল্যাণের নীতি এতে বর্তমান। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল বিষয়ের দিক-নির্দেশনা রয়েছে এ কিতাবে। এ গ্রন্থ বিশ্বাসীদের জন্য পথপ্রদর্শক।
এ কিতাবের তেলাঅত আবেদের যিকর ও ইবাদত। এর একটি অক্ষর পাঠ করলে ১০টি সওয়াব লাভ হয়।
এই কুরআন হল, মহান আল্লাহর মজবুত রশি।
এই কুরআন হল, মুসলিমের দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সকল কিছুর বিবরণী-গ্রন্থ।
এই কুরআন হল, তার অনুসারীর গৌরববৃদ্ধিকারী এবং তার বিরোধীর গৌরব ক্ষুন্নকারী।
এই কুরআন হল, সর্ব যুগের চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।
এই কুরআন হল, অপরিবর্তিত ও অপরিবর্ধিত অবস্থায় কিয়ামত অবধি মানুষের পথপ্রদর্শক।
এই কুরআন হল, এমন গ্রন্থ; যার হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ তার অবতীর্ণকারী মহান আল্লাহ।
এই কুরআন হল, বিজ্ঞানময়; যার সাথে সঠিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কোন সংঘর্ষ নেই।
এই কুরআন হল, এমন গ্রন্থ; যার সত্যতায় কোন প্রকার সন্দেহ নেই।
এই কুরআন হল, মানুষের দৈহিক ও হার্দিক আধি ও ব্যাধির মহৌষধ।
এই কিতাবের দুটি আয়াত দুটি উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ! অনুরূপ ৩টি আয়াত ৩টি উষ্টগ্ধী, ৪টি আয়াত ৪টি উষ্টগ্ধী এবং এর চেয়ে অধিক সংখ্যক আয়াত ঐর™প অধিক সংখ্যক উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ!” (মুসলিম ৮০৩ নং)
নামাযের মধ্যে তিনটি আয়াত পাঠ করা তিনটি বড় বড় হৃষ্টপুষ্ট গাভিন উষ্টগ্ধী অপেক্ষা উত্তম!” (মুসলিম ৫৫২ নং)
এ কুরআন যে শিখে ও শিক্ষা দেয় সেই হল শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যত্তিজ্ঞ সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিখেছে এবং অপরকে শিখিয়েছে।” (বুখারী ৫০২৭ নং)
এই ক্বুরআনের (শুদ্ধভাবে পাঠকারী ও পানির মত হিফযতকারী পাকা) হাফেয মহাসম্মানিত পূতচরিত্র লিপিকার (ফিরিশ্তাবর্গের) সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি (পাকা হিফয না থাকার কারণে) কুরআন পাঠে ‘ওঁ-ওঁ’ করে এবং পড়তে কষ্টবোধ করে তার জন্য রয়েছে দুটি সওয়াব। (একটি তেলাঅত ও দ্বিতীয়টি কষ্টের দরুন।) (মুসলিম ৭৯৮ নং)
মানবমণ্ডলীর মধ্য হতে আল্লাহর কিছু বিশিষ্ট লোক আছে; আহলে কুরআন (কুরআন বুঝে পাঠকারী ও তদনুযায়ী আমলকারী ব্যক্তিগণই) হল আল্লাহর বিশেষ ও খাস লোক। ” (আহমদ, নাসাঈ, বাইহাক্বী, হাকেম, সহীহুল জামে ২১৬৫ নং)
কিয়ামতের দিন কুরআন উপস্থিত হয়ে বলবে, হে প্রভু! কুরআন পাঠকারীকে অলংকৃত করুন। ’ সুতরাং তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। পুনরায় কুরআন বলবে, ‘হে প্রভু! ওকে আরো অলংকার প্রদান করুন।’ সুতরাং তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অতঃপর বলবে, ‘ হে প্রভু! আপনি ওর উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। ’ সুতরাং আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। অতঃপর তাকে বলা হবে, ‘ তুমি পাঠ করতে থাক আর মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। ’ আর প্রত্যেকটি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব বৃদ্ধি করা হবে। (তিরমিযী, সহীহুল জামে’ ৮০৩০ নং)
ক্বুরআনের বিভিন্ন নাম: ফুরকান (হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী), কিতাব (গ্রন্থ), হুদা (পথ-নির্দেশক), নূর (জ্যোতি), রাহমাহ (করুণা), যিকর (উপদেশ), তানযীল (অবতীর্ণ) প্রভৃতি।
ক্বুরআনের বিভিন্ন গুণ: কারীম (সম্মানিত), মাজীদ (গৌরবান্বিত), হাকীম (বিজ্ঞানময়), হাক্ক, (সত্য), মুবীন (সুস্পষ্ট), আহসানুল হাদীস (সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী), ক্বওলুন ফাসল (সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী বাণী), সুহুফ মুত্বাহহারাহ (পূত-পবিত্র)। আর এই অর্থে বাংলায় পবিত্র কুরআন বা কুরআন শরীফ বলা হয়।
ক্বুরআনের আয়াতসমূহ দুই শ্রেণীর; এর অধিকাংশ আয়াত মুহকাম ও স্পষ্ট অর্থবোধক। কিছু আয়াত আছে মুতাশাবিহ ও র™পক; যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। যেমন কিছু আয়াত আছে, যা প্রয়োজনে অবতীর্ণ হয়েছে এবং প্রয়োজনেই তার নির্দেশ রহিত হয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য যে, এ গ্রন্থে পরস্পর-বিরোধী কোন কথা নেই; সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে কোন সংঘর্ষ নেই। নেই কোন অবাস্তব কথা।
কুরআন মাজীদের কিছু সূরা ও আয়াত মক্কী এবং কিছু মাদানী। মক্কী আয়াতে সাধারণতঃ মহান আল্লাহর তওহীদ (একত্ব), রসূলের রিসালত ও পরকাল সম্বন্ধে আলোচিত হয়েছে। মাদানী আয়াতে সাধারণতঃ আলোচিত হয়েছে সামাজিক বিধি-বিধান, ফৌজদারী আইন-কানুন, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিধান। মক্কী সূরা ৮৬টি এবং মাদানী সূরা ২৮টি।
আল-ক্বুরআনের মোট সূরা ১১৪টি। পারা ৩০টি। রুকূ (যতটুক অংশ পড়ে নামাযে রুকূ করা যায় তার সংখ্যা) ৫৫৮টি। হিযব (প্রতিদিন নিয়মিত তেলাঅতের নির্দিষ্ট অংশ) ৬০টি। প্রসিদ্ধ মতানুসারে মোট আয়াত ৬৬৬৬টি। শব্দ ৭৭৪৩৯টি। অক্ষর ৩৪০৭৪০টি। সিজদায়ে তিলাঅত ১৫টি।
এক সপ্তাহে খতম করার জন্য কুরআন কারীমকে সাত মঞ্জিলে ভাগ কে করেছেন, তা অজানা। অবশ্য মোবারক করীম জওহর সাহেব নবী @-এর কথাই উল্লেখ করেছেন। জানি না, তা কোন দলীলের ভিত্তিতে?
তেলাঅতের সুবিধার জন্য কুরআন কারীমের ‘ পারা’ বা সিপারায় ভাগ করেছেন কে তার কোন সঠিক হদীস মিলে না। ধারণা করা হয়, সাহাবায়ে কেরাম এ ভাগ করে গেছেন। তবে এ বিভক্তি বিষয়-ভিত্তিক বা অর্থ হিসাবে নয়। কেবল নিয়মিত তেলাঅত করে মাসে একবার কুরআন খতম করা সুবিধার জন্য সমান ৩০ ভাগে ভাগ করা হয়েছে বলে মনে হয়।
‘ রুকূ’ দ্বারা ভাগ কে করেছেন, তারও কোন হদীস মিলে না। যদিও মোবারক করীম জওহর সাহেব লিখেছেন যে, তা হযরত ওসমান <-এর আমলেই নির্ধারিত হয়। অথচ তিনি ‘ হিযব’ নির্ধারিত করেছেন বলে কথিত হয়। আর তার জন্যই সঊদী ছাপা ওসমানী কুরআনে ‘ হিযব’ আছে, রুকূ নেই।
কুরআন কারীমের আকারে সবচেয়ে বড় সূরা: সূরা বাক্বারাহ।
কুরআন কারীমের মর্যাদায় সবচেয়ে বড় সূরা: সূরা ফাতিহাহ।
কুরআন কারীমের আকারে সবচেয়ে বড় আয়াত: সূরা বাক্বারার ২৮২নং আয়াত।
কুরআন কারীমের মর্যাদায় সবচেয়ে বড় আয়াত: সূরা বাক্বারার ২৫৫নং আয়াত (আয়াতুল কুরসী)।
কুরআন কারীমের আকারে সবচেয়ে ছোট সূরা: সূরা কাউষার।
কুরআন কারীমের আকারে সবচেয়ে ছোট আয়াত: সূরা ত্বাহার প্রথম আয়াত।
কুরআন কারীমের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ সূরা: সূরা ফাতিহাহ।
কুরআন কারীমের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত: সূরা আলাক্বের প্রথম ৫ আয়াত।
কুরআন কারীমের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা: সূরা নাসর।
কুরআন কারীমের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত: সূরা বাক্বারার ২৮১নং আয়াত।
কুরআন কারীমে মোট ১১৪টি সূরায় ১১৪টি ‘ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ আছে। অবশ্য সূরা তাওবার প্রথমে ‘ বিসমিল্লাহ—’ নেই। কিন্তু সূরা নামলের শুরুতে এবং মাঝে এক স্থানে মোট ২টি ‘ বিসমিল্লাহ—’ আছে।
মর্যাদায় সূরা ‘ ইখলাস’ ক্বুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। যেমন সূরা ‘ কাফিরূন’ ক্বুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান।
কুরআন মাজীদে মোট ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ হয়েছে।
মহানবী (ﷺ) -এর ‘মুহাম্মাদ’ নাম উল্লেখ হয়েছে ৪ বার। ‘আহমাদ’ নাম উল্লেখ হয়েছে ১বার।
সাহাবার মধ্যে উল্লেখ হয়েছে কেবল যায়দ (رضي الله عنه) এর নাম।
মহিলাদের মধ্যে উল্লেখ হয়েছে কেবল মারয়্যামের নাম।
মাসের মধ্যে উল্লেখ হয়েছে রমযান মাসের নাম।
সূরা ক্বামার, রহমান ও ওয়াক্বিআহ পরপর ৩টি সূরাতেই ‘আল্লাহ’ শব্দ উল্লেখ হয়নি। যেমন সূরা মুজাদালার প্রত্যেক আয়াতে তা উল্লেখ হয়েছে।
কুরআন মাজীদের অর্ধাংশ হল সূরা কাহফের ১৯নং আয়াতের وليتلطف শব্দ। كَلَّا শব্দটি প্রথম অর্ধাংশের কোথাও ব্যবহার হয়নি।
কুরআন মাজীদের দু’ টি আয়াতে আরবী ভাষার মোট ২৮টি অক্ষরের সবগুলিই ব্যবহার হয়েছে; সূরা আলে ইমরানের ১৫৪নং এবং সূরা ফাতহের ২৯নং আয়াতে।
কুরআনের আরো বহু অজানাকে জানতে তফসীর পড়ুন। আরো অন্যান্য বই-পুস্তক পড়ুন। কুরআন আমাদের জীবন-বিধান, সেই বিধান অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করুন, বিচারক তা দিয়ে বিচার করুন, শাসক তা দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করুন এবং রাজা তা দিয়ে রাজত্ব চালান। ক্বুরআনের নীতি মেনে নিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীভূত করুন এবং ক্বুরআনী আইন প্রয়োগ করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করুন। উপদেশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন পড়ুন, উপদেশ পাবেন। উ›মুক্ত মন নিয়ে কুরআন পাঠ করুন, তাহলে কুরআন সম্বন্ধে সকল সন্দিহান থেকে মুক্ত হতে পারবেন। কুরআন পাঠ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি দুশ্চিন্তা দূর করুন; আল্লাহর নিকট দুআ করুন এই বলে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِيْ بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاءُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِيْ كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَداً مِّنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِيْ عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدِكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِيْ، وَنُوْرَ صَدْرِيْ وَجَلاَءَ حُزْنِيْ وَذَهَابَ هَمِّيْ.
হে আল্লাহ! নিঃসন্দেহে আমি তোমার দাস, তোমার দাসের পুত্র ও তোমার দাসীর পুত্র, আমার ললাটের কেশগুচ্ছ তোমার হাতে। তোমার বিচার আমার জীবনে বহাল। তোমার মীমাংসা আমার ভাগ্যলিপিতে ন্যায়সঙ্গত। আমি তোমার নিকট তোমার প্রত্যেক সেই নামের অসীলায় প্রার্থনা করছি- যে নাম তুমি নিজে নিয়েছ। অথবা তুমি তোমার গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছ, অথবা তোমার সৃষ্টির মধ্যে কাউকে তা শিখিয়েছ, অথবা তুমি তোমার গায়বী ইলমে নিজের নিকট গোপন রেখেছ, তুমি কুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত কর, আমার বক্ষের জ্যোতি কর, আমার দুশ্চিন্তা দূর করার এবং আমার উদ্বেগ চলে যাওয়ার কারণ বানিয়ে দাও। (মুসলিম আহমদ ১/৩৯১) আল্লাহ আমাদেরকে তওফীক দিন, যেন আমরা ক্বুরআনের নিয়ম-নীতির অনুবর্তী হতে পারি। এই তফসীর প্রকাশনার ব্যাপারে যাঁরাই যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, আল্লাহ তাঁদেরকে এবং আমাদেরকে তার নেক প্রতিদান দান করুন, এই মহতি কাজের অসীলায় তাঁর বেহেশ্তে স্থান দান করুন। আমীন।
বিনীত –
আব্দুল হামীদ ফাইযী
আল-মাজমাআহ, সঊদী আরব
২০/৫/১৪২৯হিঃ (২০০৮)

তাফসীর আহসানুল বায়ান
admin –
অনন্য সাধারণ একটি তাফসীর, এক মলাটে সংক্ষিপ্ত অথচা পূর্ণাঙ্গ তাফসীর।